পরিবেশ দূষণ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের একমাত্র কারণ তদারূপ আমাদের আলোচ্য বিষয় হল Environmental Polution বা পরিবেশ দূষণ : সংজ্ঞা, ধারণা, প্রকারভেদ, বায়ু, জল, মাটি, শব্দ দূষণের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে।
পরিবেশ :
পরিবেশ বলতে মানুষের পারে-পার্শ্বিক অবস্থাকে বোঝায় অর্থাৎ মানুষ যেসব পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করে এবং দৃশ্য ও অদৃশ্য উপাদান তার জীবন ও জীবিকার উপর যে প্রভাব বিস্তার করে সম্মিলিতভাবে তাকে পরিবেশ বলে।
পরিবেশ দূষণ কাকে বলে :
জীব মণ্ডলের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন যা জীবজগত পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে।
পরিবেশ দূষণের ধারণা :
দূষণ হল জীবমণ্ডলের ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যের এমন অনাকাঙ্খিত সুবিশাল পরিবর্তন যা জীবজগৎ ও পরিবেশের ওপরে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। যন্ত্রচালিত আধুনিক সভ্যতা, শিল্প বিপ্লব, বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, ভোগবাদ, অতিরিক্ত ভোগ্যপণ্য উৎপাদন, অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং অতিরিক্ত সংশ্লেষিত দ্রব্যের অত্যাধিক পরিমাণে ব্যবহারের ফলেই পৃথিবীর বায়ু, জল, মাটি আজ দুষিত ও বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠছে দিন দিন। পৃথিবীব্যাপী এই মারাত্মক দূষণের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য আজ বিঘ্নিত যা ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ছে পরিবেশে, মানবশরীরে ও মানব অর্থনীতিতে।
পরিবেশ দূষণের প্রকারভেদ :
পরিবেশদূষণ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ গুলির মধ্যে হল- বায়ুদূষণ, জলদূষণ, মাটিদূষণ, শব্দদূষণ প্রভৃতি।
বায়ু দূষণ (Air pollution) : প্রাকৃতিক কারণে বা মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের দ্বারা বায়ুমণ্ডলের উপাদানের হ্রাস বা বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়, তাকে বায়ুদূষণ বলে।
জল দূষণ (Water pollution ) : প্রাকৃতিক কারণে বা মনুষ্যসৃষ্ট কারণে জলে ক্ষতিকারক জীবাণু বা অবাঞ্ছিত বস্তুর উপস্থিতির ফলে জলের যে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে, তাকে জলদূষণ বলে।
মাটি দূষণ (Soil pollution) : অবাঞ্ছিত জৈব পদার্থ বা রাসায়নিক পদার্থের সংযোজনের ফলে মাটির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের যে পরিবর্তন ও গুণগত মানের অবক্ষয় ঘটে, তাকে মাটিদূষণ বলে।
শব্দদূষণ (Sound pollution) : সহনশীলতা অতিক্রমকারী শব্দ যখন শ্রোতার কাছে পীড়াদায়ক হয় এবং প্রাণীদের শারীরিক ও মানসিক সাম্যাবস্থাকে বিঘ্নিত করে, তাকে শব্দদূষণ বলে।
পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ গুলি কি কি এবং ফলাফল :
পরিবেশ দূষণের কারণগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-
বায়ু দূষণের প্রধান কারণ গুলি কি কি :
1.গ্রিনহাউস গ্যাস :বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা ও মোটর গাড়ি থেকে নির্গত ধোয়ার নানারকম গ্রীন হাউস গ্যাস যেমন CO2, NH3, N2O, NO, CFC প্রভৃতি বায়ুকে দূষিত করে ।
2. কণাগত পদার্থ :মোটর গাড়ির ধোঁয়ায় থাকা বেঞ্জোপাইরিন, তাপবিদ্যুৎ ও সিমেন্ট কারখানার উড়ন্ত ছাই, অ্যাসবেসটস কনা, সিলিকা, অভ্র, কয়লা পাট, কার্পাস এবং প্রভৃতি জৈব কণা বায়ু দূষিত করছে ।
বায়ু দূষণের ফলাফল গুলি আলোচনা কর :
অ্যাসিড বৃষ্টি :
1. H2S, NO2 ও CO2, গ্যাসগুলি H2SO4, HNO3 ও H2CO3 সৃষ্টি করে অ্যাসিড বৃষ্টি বা অম্লবৃষ্টি ঘটায় যা জলে মিশে জলকে আম্লিক করে তোলে যার ফলে বিভিন্ন জলজ প্রাণী ক্ষতির মুখে পড়ে।
2. উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষে ব্যাহত হয়।
3. অ্যাসিড বৃষ্টির ফলে পরিবেশের মডেল স্ট্যাচু ও ঘরবাড়ির ক্ষতি সাধন করে।
4. অ্যাসিড বৃষ্টির ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ও সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি পায়।
5. অ্যাসিড বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তিত হয় যেমন কোথাও খরা, কোথাও অতিবৃষ্টি কোথাও আবার অনাবৃষ্টি দেখা যায়।
5. অ্যাসিড বৃষ্টির ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ক্ষতির মুখে পরে।
বায়ু দূষণের কারণে কি কি রোগ হয় :
ছোট ছোট কণাগুলি ফুসফুসের মধ্যে প্রবেশ করে ফুসফুসে নানারকম রোগের সৃষ্টি করে যেমন অ্যাসবেসটস কণা ফুসফুসের ক্যানসার, কয়লার গুড়ো অ্যানথ্রাকোসিস, ব্ল্যাকলাং , তুলোতন্তু বিসিনোসিস, অ্যালার্জি প্রভৃতি রোগ সৃষ্টি করে।
জল দূষণের কারণ গুলি কি কি :
1. কৃষিক্ষেত্রের বর্জ্য পদার্থ : কৃষি কাজের জন্য বিভিন্ন রকম রাসায়নিক সার ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম, সালফেট, সুপার ফসফেট, পটাশ ও বিভিন্ন রকম কীটনাশক ও আগাছানাশকের কারণে জল দূষণ হচ্ছে।
2.জীবাণু : গৃহস্থালি ও পৌর প্রয়ঃপ্রণালীর বিভিন্ন রকম জীবাণু জলে মিশে জলকে দূষণের ফলে নানারকম রোগের সৃষ্টি করছে।
জল দূষণের ফলাফল :
ইউট্রোফিকেশন : ফসফেট জাতীয় রাসায়নিক সার ও ডিটারজেন্ট জলে মেশার ফলে জলজ উদ্ভিদের অতিবৃদ্ধি ঘটে একে ইউট্রোফিকেশন বলে।
1. শ্যাওলার অতিবৃদ্ধি ও মৃত শ্যাওলার পচনের ফলে ব্যাপক মাত্রায় জল দূষণ হচ্ছে। এর ফলে জলের O2 এর পরিমাণ হ্রাস পায় অ্যালগাল ব্লুম বলে।
2. ইউট্রোফিকেশন এর ফলে জলের BOD বৃদ্ধি পায় এর ফলে বিভিন্ন জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
জীবাণুঘটিত রোগ : ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া প্রোটোজোয়া, কৃমি প্রভৃতি দূষিত জলে উপস্থিত থাকাই বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে । জল দূষণের ফলে রোগ গুলি মানবদেহে বাঁসা বাঁধছে।
1. হেপাটাইটিস ভাইরাসের সংক্রমে হেপাটাইটিস রোগের সৃষ্টি হয়।
2. ভিব্রিও কলেরি সালমোনেল্লা নামক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমনের ফলে কলেরা ও টাইফয়েড রোগের সৃষ্টি হয়।
3. এন্টামিবা, হিস্টোলাইটিকা,জিয়ার্ডিয়া প্রভৃতি আদ্যপ্রাণীর সংক্রমনে আমাশা, জিয়ার্ডিয়েসিস রোগের সৃষ্টি হয়।
মাটি দূষণের কারণ গুলি কি কি :
জীবাণু : বিভিন্ন রকম পৌর আবর্জনা মানুষ ও প্রাণীর মলমূত্র মাটিকে বিভিন্ন ভাবে দূষিত করছে।
রাসায়নিক পদার্থ : বিভিন্ন রকম সার ও কীটনাশক (ম্যালাথিয়ন, অ্যালড্রিন) ও আগাছানাশক মাটির উর্বরতা ক্ষমতাকে নষ্ট করে মাটিকে দূষিত করছে।
মাটি দূষণের ফলাফল :
মনুষ্যজাতির উপর প্রভাব : সরাসরি মাটির সঙ্গে স্পর্শ বা প্রশ্বাসের মাধ্যমে মাটিদূষক দেহে প্রবেশ করলে বিভিন্ন রকমের রোগের সৃষ্টি করে।
মাটি দূষণের ফলে কি কি রোগ হয় :
1. পোলিওমাইলাইটিস ভাইরাসের সংক্রমণে শিশুদের পোলিও রোগের সৃষ্টি হয়।
2. রোটা ভাইরাসের সংক্রমনে শিশুদের উদরাময় রোগের লক্ষণ দেখা যায়।
3. ব্যাকটেরিয়া ও কৃমির সংক্রমনের ফলে শিশুদের বিভিন্ন রকম রোগের সৃষ্টি হয়।
জৈব বিবর্ধন : অর্গানোক্লোরিন ও অর্গানোফসফেট জাতীয় কীটনাশক কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে এরা সর্বশেষে জলে মেশে এবং জীবদেহে ফ্যাট জাতীয় পদার্থে সঞ্চিত হতে থাকে। এগুলি অভঙ্গুর দূষক এবং খাদ্যশৃঙখলের মাধ্যমে প্রতি পুষ্টি স্তরে প্রবেশ করে। পুষ্টিস্তর দিয়ে সঞ্চিত হওয়ার সময় প্রতিটি পুষ্টিস্তরে দূষকগুলির ঘনত্ব বৃদ্ধি পায় ও সর্বত্র পুষ্টি স্তরে ঘনত্ব সর্বাধিক হয় এই ঘটনাকে জৈব বিবর্ধন বলে।
শব্দ দূষণের কারণ গুলি আলোচনা কর:
যানবাহন : ট্রাম, বাস, লরি প্রভৃতির ইলেকট্রিক হর্ন, চাকার ঘর্ষণ, মোটোর ইঞ্জিন প্রকৃতির আওয়াজ শব্দ দূষিণ করে।
শিল্প : বিভিন্ন রকম প্রেসের মেশিন, টেক্সটাইল লুম, নিউজ পেপার প্রেস, পাঞ্চিং মেশিন, গাড়ি সারাই সাইরেন প্রকৃতির অত্যাধিক আওয়াজের ফলে শব্দ দূষিত হচ্ছে।
শব্দ দূষণের ফলাফল :
মানুষের উপর প্রভাব :
1.শব্দ দূষণের ফলে মানুষের শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
2. ১০০ ডেসিমেল শব্দের মধ্যে থাকলে বধিরতা দেখা দেয় কারণ কানের অর্গান অফ কর্টির কোষগুলি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
3. দীর্ঘক্ষন জোরালো আওয়াজের ফলে হৃৎপিণ্ডের উপর প্রভাব ফেলে এতে হৃৎস্পন্দনে ও রক্তচাপের হার বেড়ে যায়।
অন্যান্য প্রাণীর উপর প্রভাব :
1. কুকুর, বিড়াল এবং অন্যান্য বন্য প্রাণীরা জোরালো শব্দ সহ্য করতে পারে না সেই সঙ্গে জোরালো আওয়াজের ফলে শিকারে বাধা ঘটে।
2. অত্যাধিক মাত্রায় শব্দের ফলে বিভিন্ন প্রাণীর (যেমন পাখি) প্রজননে লিপ্ত হতে বাধা সৃষ্টি করে।
Read More : উচ্চমাধ্যমিক বাংলা সাজেশন 2023
পরিবেশ দূষণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন:
1. পরিবেশ দূষণের উৎস গুলি কি কি ?
উ: তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা প্রভৃতি।
2.অ্যাসিড বৃষ্টি কি ?
উ: যে বৃষ্টির জলে সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড এবং অল্প পরিমাণে এবং হাইড্রোজেন অ্যাসিড বিদ্যমান থাকে তাকে অ্যাসিড বৃষ্টি বলে।
3. ব্ল্যাকফুট রোগ কিসের জন্য হয় ?
উ: আর্সেনিক দূষণের ফলে।
4.WHO পানীয় জলে আর্সেনিকের পরিমাণ কতটা ধার্য করেছে ?
উ: প্রতিলিটারে 0.05 মিলিগ্ৰাম।
5. বায়ুমন্ডলের কোন স্তরের মধ্যে ওজোন স্তরটি অবস্থিত ?
উ: স্ট্যাটোস্ফিয়ার
6. স্টোন ক্যানসার কাকে বলে ?
উ: অ্যাসিড বৃষ্টির ফলে মার্বেল পাথরে তৈরি সৌধ ও ভাস্কর্যের উপর যে ক্ষতিকরে তাকে তাকে স্টোন ক্যানসার বলে।
7. শব্দের তীব্রতা মাপার একককে কি বলে ?
উ: ডেসিবেল
8. বিশ্ব পরিবেশ দিবস কবে পালন করা হয় ?
উ: 5 ই জুন।
9. ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী কোন গ্যাস ?
উ: ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন CFC
10. ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মূল গ্যাসটির নাম কি ?
উ: মিথাইল আইসোসায়ানেট
11. ভূগর্ভস্থ জল দূষণের প্রধান উৎস কি ?
উ: আর্সেনিক
12. পারদ দূষণের ফলে কোন রোগটি দেখা যায় ?
উ: মিনামাটা
13. বায়ুমণ্ডলের কোন গ্যাস অ্যাসিড বৃষ্টির জন্য দায়ী ?
উ: সালফার ডাই অক্সাইড
14. সাইলেন্ট ভ্যালি কোথায় অবস্থিত ?
উ: দক্ষিণ ভারতের কেরল রাজ্যের পালঘাট জেলায় অবস্থিত।
15.Green Muffler কিসের সাথে জড়িত ?
উ: শব্দ দূষণের সাথে
16. ইটাই ইটাই রোগের কারণ কি ?
উ: ক্যাডমিয়াম দূষণের ফলে।
17. কয়লা খনির শ্রমিকদের কি রোগ দেখা যায় ?
উ: ব্ল্যাক ল্যাং
18. যানবাহনের ধোঁয়া থেকে কোন গ্যাস নির্গত হয় ?
উ: কার্বন-ডাই-অক্সাইড
19. পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ কি ?
উ: শিল্পায়ন, বিভিন্ন কলকারখানার জ্বালানি হিসেবে বিভিন্ন রকম খনিজ তেল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতির জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার দূষণের মূল কারণ।
20. পরিবেশ দূষণ গুলি কি কি ?
উ: পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ দূষণ গুলি হল বায়ু দূষণ, জল দূষণ, মাটি দূষণ, শব্দ দূষণ।
10 thoughts on “পরিবেশ দূষণ কাকে বলে ? পরিবেশ দূষণের ধারণা, প্রকারভেদ, বায়ু, জল, মাটি, শব্দ দূষণের কারণ ও ফলাফল”