পট কি : সুপ্রিয় ছাত্রছাত্রী আজকের এই পর্বটিতে আমরা আলোচনা করলাম পট কি এবং ‘পট‘ কত প্রকার ও কি কি সম্পর্কে। চলুন দেখে নেওয়া যাক বিস্তারিত আলোচনাটি।
পট কি বা পট শব্দের অর্থ কি :
বাংলা লোকশিল্পের অতি প্রাচীন মাধ্যম পটচিত্র দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে বিস্তৃতি লাভ করে। সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দটির অর্থ ‘বস্তু’ বা ‘কাপড়।’ বাংলায় ‘পট’ শব্দটির উদ্ভব এই থেকেই। কাপড়, কাগজ, মাটির উপর অঙ্কিত চিত্রই হল পট। কিন্তু যখন ‘পট’- এর উপর চিত্রাঙ্কন করা হয়, তখন তা শুধু কাপড় থাকলে চলে না। লোকশিল্পীরা এক ফালি কাপড়কে কখনও কাদাগোলায় ডুবিয়ে শক্ত কোনো আধারে স্থাপন করে, শুকিয়ে গেলে তার উপর খড়িমাটি মাখিয়ে চিত্রাঙ্কন করে অথবা সরাসরি বস্ত্রখণ্ডকে খড়িগোলায় ডুবিয়ে একই পদ্ধতিতে পটের জমি প্রস্তুত করেন। চিত্রাঙ্কনের উপযুক্ত হয়ে শুকিয়ে গেলে রং দিয়ে এর উপর কাজ করা হয়।
পটের পরিচয় : পটশিল্পীরা পটুয়া, চিত্রকর প্রভৃতি নামে লোকমুখে কথিত হন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চণ্ডীলীলা, রামায়ণ, মহাভারত, পদ্মাপুরাণ, মহরম, গাজীর পট ইত্যাদি ছিল গায়েনদের বিষয়।
বাংলার পটচিত্রে কখনও আয়তাকার পট ও কখনও বিস্তৃত লম্বমান পটের দেখা পাওয়া যায়। লোকতাত্ত্বিকরা পরিবেশ ও অবস্থান অনুযায়ী এবং বিষয় ও শৈলী অনুসারে বাংলার পটকে সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করেছেন।
পটের প্রকারভেদ :
1. আদিবাসীদের পট : এই পটশিল্পের দেখা মেলে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার বিশেষ অঞ্চলে। আসলে আদিবাসী উপকথানুসারে তাদের জন্মবৃত্তান্তের লৌকিক চিত্ররূপ এই পটশিল্প।
2. যমপট : এর বিষয় পাপপুণ্য, স্বর্গ – নরক, ধর্ম – অধর্ম ইত্যাদি ভাবনার প্রতিস্থাপন।
3. গাজীপট : এই পটের বর্ণিতব্য বিষয় মুসলিম ধর্মযোদ্ধা ও গাজী বা পীরদের বীরত্ব, মহানতা ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ।
4. হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, ধর্মকাহিনি, অবতার কাহিনি বা মহাজীবন পট : এই ধরনের পট জনজীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। কারণ লোকজীবনে ধর্মের গুরুত্ব যথেষ্ট । এই পটের বিষয় স্থানিক বৈচিত্র্য ও চাহিদা অনুসারে বদলে যায়।
বাংলার লোকশিল্প হিসেবে পট শিল্পের পরিচয় :
লোকশিল্পের অন্যতম প্রাচীন মাধ্যম পটশিল্প। বাংলাদেশেও পটশিল্পের ইতিহাস প্রাচীন। পটুয়াদের আঁকা ছবি ও সেখানে উল্লিখিত কাহিনি ধর্মপ্রচারে একান্ত সহায়ক হয়েছিল। মঙ্গলকাব্যের পট এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মুসলিম শাসকরাও ইসলাম ধর্মপ্রচারের জন্য পটুয়াদের সাহায্য নিতেন। ষোড়শ শতকে পটচিত্রের সাহায্যেই তুলে ধরা হত চৈতন্যদেবের বাণী। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে পটের উল্লেখ আছে। পুরাণ এবং লোক-কথাকে আশ্রয় করে একটি বড়ো ক্যানভাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে গল্প বলতেন পটশিল্পীরা- ছবির মাধ্যমেই এই গল্প বলা হত।
উনিশ শতকে কালীঘাটের পট বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছিল। প্রথমদিকে কালীঘাটের পটে দেবদেবীর ছবি আঁকা হলেও পরবর্তীকালে পটে উঠে আসে নানা সামাজিক প্রসঙ্গ। সামাজিক অবক্ষয়, নব্য বাবু কালচার- এসব পটশিল্পীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়। 1800 থেকে 1850 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতার বাবু – কালচারের ক্ষয়িম্বু রূপের প্রতিফলন ধরা পড়েছিল এই পটচিত্রে। কালীঘাটের পট বিশ্বজোড়া খ্যাতি পায়। ইন্দ্রমোহন ঘোষ, বলরাম দাস, কার্তিক চিত্রকর প্রমুখ আলাদ আলাদা ধারায় কালীঘাটের পটশিল্পের প্রসার ঘটান।
1 thought on “পট কি ? পট কত প্রকার ও কি কি ?”