আর্সেনিক দূষণ কি ? আর্সেনিক ও ফ্লুরাইড দূষণের কারণ ও ফলাফল

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

আর্সেনিক দূষণ কি ? আর্সেনিক ও ফ্লুরাইড দূষণের কারণ ও ফলাফল

আর্সেনিক দূষণ একটি Global Problem. পৃথিবীর সকল মহাদেশের ৫০টির মতো দেশে ভূগর্ভস্থ বা ভূপরিস্থ জলে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়েছে। তাইওয়ানে প্রথম শনাক্তকরণের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে আর্সেনিক দূষণ শনাক্ত করা হয়েছে। সর্বাধিক দূষণ আক্রান্ত এলাকা হচ্ছে- ল্যাটিন আমেরিকা (আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো, নিকাবগুয়া ও অন্যান্য দেশ); দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, মিয়ানমার) ও দক্ষিণ এশিয়া (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান)। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, স্পেন, ইটালী, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইত্যাদি দেশে বিভিন্ন মাত্রার আর্সেনিক দূষণ রয়েছে। আক্রান্ত বা ঝুঁকিগ্রস্থ জনসংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ সর্বাধিক দূষণগ্রস্থ দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

আর্সেনিক দূষণ কি :

তৃগর্ভস্থ জলস্তরে সঞ্চিত জলকে বলা হয় ভৌমজল। কোনো কোনো অঞ্চলে ভূগভস্থ জলস্তর, কাছাকাছি থাকা আর্সেনিকঘটিত যৌগস্তরের সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে। টিউবওয়েল দ্বারা ক্রমাগত জল উত্তোলনের ফলে ওইসকল স্তরে প্রচুর পরিমাণে বায়ুপ্রবেশ করে। আর্সেনিক ঘটিত অদ্রাব্য যৌগের সঙ্গে বায়ুর বিক্রিয়ায় জলে দ্রাব্য আর্সেনাইট ও আর্সেনেট লবণ উৎপন্ন হয়। ফলে ওই জলস্তরে আর্সেনিকঘটিত দূষণ ঘটে।

পশ্চিমবঙ্গের সাতটি জেলায় কোনো কোনো অঞ্চলের নলকূপের জলে স্বাভাবিকের চেয়ে 200 গুণ বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। মানচিত্রের সাহায্যে এদের অবস্থান ও ভৌমজলে আর্সেনিক দূষণের পরিমাণ দেখানো হল। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলে আর্সেনিক দূষণ ছড়িয়েছে। একথা মনে রেখো যে, ভৌমজলে দূষণ সৃষ্টির জন্য মৌল আর্সেনিকের কোনো ভূমিকা নেই। আর্সেনাইট ও আর্সেনেট লবণগুলো জলে দ্রবীভূত হয়ে দূষণের সৃষ্টি করে।

আর্সেনিক দূষণের কারণ :

1. আমরা কৃষিক্ষেত্রে আর্সেনিক যৌগ আগাছানাশক হিসেবে ব্যবহার করি। এগুলো বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ভূগর্ভে পৌঁছায় এবং জলকে দূষিত করে।

2. কলকারখানা থেকে উৎপন্ন আর্সেনিকযুক্ত বজ্র পদার্থ বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ভূগর্ভে পৌঁছাই এবং জলকে দূষিত করে।

3. বর্তমানে অধিক পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের ফলে জলস্তর আর্সেনিক পকেটের নিচে নেমে গেছে। এই কারণে আর্সেনিক ভূগর্ভস্থ জলে নেশার সুযোগ পাচ্ছে এবং জলকে দূষিত করছে।

আর্সেনিক দূষণের ফলাফল :

1. আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক খসখসে হয়। কাঁধ, বুক, হাতের তালু ও পায়ের তলায় কালচে ধূসর বর্ণের চাকা চাকা দাগ দেখা যায়। পায়ের পাতায় কালো দাগ সৃষ্টি হয় একে ব্ল্যাকফুট ডিজিজ বলে।

2. পায়ের তলায় আঁচিলর মতো গুটি বের হয়।

3. যকৃতের স্থায়ী বিকৃতি, ফুসফুসে এবং অন্ত্রে ক্ষত দেখা দেয় ।তা ছাড়া ওসব অঙ্গে ক্যান্সার হতে পারে।

4. অধিকার্সেনিকযুক্ত জলে পানের ফলে বমি, পেটে যন্ত্রণা, ডায়রিয়া প্রভৃতি উপসর্গ দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে বমির সঙ্গে রক্তনির্গত হয় এবং রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে।

আর্সেনিক দূষণ মোকাবেলার পদ্ধতি :

পানীয় জল থেকে আর্সেনিকঘটিত দূষণ দূরীকরণের কয়েকটা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।

অধিশোষণ পদ্ধতি :

আর্সেনাইট ও আর্সেনেট —এই দুই ধরনের লবণই সক্রিয় অ্যালুমিনা দ্বারা অধিশোষিত হয়। তাই টিউবওয়েলের নলের সঙ্গে অ্যালুমিনা-নির্মিত স্তম্ভ সংযুক্ত করে আর্সেনিক মুক্ত ভৌমজল পাওয়া যায়।

সহঅধঃক্ষেপণ পদ্ধতি :

জলের সাথে পরিমাণমতো রিচিং পাউডার মিশিনো ভালোভাবে নেড়ে বেশ কয়েকঘন্টা রেখে দেওয়ার পর খানিকটা ফটকিরি বা ফেরিক (Fe3) লবণ মিশিয়ে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে রেখে দিলে বেশিরভাগ আসেনিঘটিত যৌগগুলো থিতিয়ে পড়ে। পরিস্রাবণের মাধ্যমে অধঃক্ষেপ আলাদা করে নিলে যে জল পাওয়া যায়, তা 90-95% পর্যন্ত আর্সেনিক মুক্ত হয়। এ ছাড়া ভূগর্ভস্থ জলকে উত্তোলনের সাথে সাথে পান না করে বায়ুর সংস্পর্শে দু-একদিন রেখে দিলে আর্সেনিকযুক্ত যৌগগুলোর কিছু অংশ থিতিয়ে পড়ে। ওপরের স্বচ্ছ জলকে ফিলটার দ্বারা পরিশ্রুত করে নিলে 60-70% আর্সেনিক দূরীভূত হয়।

আয়ন বিনিময় পদ্ধতি :

এই পদ্ধতিতে অ্যানায়ন বিনিময়কারী রেজিনের মধ্য দিয়ে আর্সেনিক দূষণযুক্ত জলকে অতিক্রম করালে আর্সেনেট লবণগুলি (ASO উপরে 3― নীচে 4 ) দূরীভূত হয় কিন্তু আর্সেনাইট লবণগুলি (ASO উপরে 3― নীচে 4 ) থেকে যায়। কাজেই আর্সেনিক ঘটিত দূষণ আংশিকভাবে দূরীভূত হয়।

UV রশ্মির সাহায্যে:

আর্সেনাইট (ASO উপরে 3― নীচে 4 ) লবণযুক্ত জলকে UV রশ্মির সাহায্যে O2 দ্বারা জারিত করলে আর্সেনেট (ASO উপরে 3― নীচে 4 ) লবণ উৎপন্ন হয়। এরপর এই জলের মধ্যে ফেরিক লবণ যোগ করলে ফেরিক আর্সেনেট (FeASO4) অধঃক্ষিপ্ত হয়। অধঃক্ষেপকে পরিস্রাবণ প্রক্রিয়ায় পৃথক করলে আর্সেনিকমুক্ত জল পাওয়া যায়।

বিপরীত অভিস্রবণ পদ্ধতি :

এই পদ্ধতিতে সেলুলোজ ট্রাইঅ্যাসিটেটকে অর্ধভেদ্য পর্দাৰূপে ব্যবহার করে জল থেকে আর্সেনিক দূরীভূত করা হয়। জল থেকে আর্সেনিক দূরীকরণের এটি একটি উন্নততর পদ্ধতি।আর্সেনিকযুক্ত জলের নলকূপ গুলিকে  সাথে সাথে সিল করে দিতে হবে এবং নতুন করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে।

ভৌমজলে ফ্লুরাইডঘটিত দূষণ :

জলে ফ্লুরাইডের সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রা 1.5mg / L ‌। পানীয় জলে সামান্য পরিমাণে ফ্লুরাইড লবণ (1.0 mg / L) থাকা প্রয়োজন। যা দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। কিন্তু অধিক পরিমাণ ফ্লুরাইড থাকলে তা ক্ষতিকারক। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত পুরুলিয়া-I, পুরুলিয়া-II ও হুরা এই তিনটে ব্লকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভৌম জলে ফ্লুরাইডের পরিমাণ  বিপদসীমার অনেক ওপরে রয়েছে।

ফ্লুরাইডঘটিত খনিজ পদার্থ, ক্রায়োলাইট, ফ্লুরঅ্যাপাটাইট এবং ফ্লুয়োস্পার এবং ফ্লুয়োস্পার থেকে ওইসব অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলে বা বিভিন্ন জলাশয়ে ফ্লুরাইড দূষণের সৃষ্টি হয়। বীরভূম, বাঁকুড়া ও মালদহ জেলাতেও মাটির নীচে ফুরিনের কিছু খনিজ পদার্থ আছে। ওই সকল খনিজ পদার্থের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ভূগর্ভস্থ জলে কিছুটা ফ্লুরাইড আয়ন দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও রাজস্থান, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক,তামিলনাড়ু প্রভৃতি রাজ্যে প্রাকৃতিক জলে অতি উচ্চমাধ্যায় ফ্লুরাইড লবণ বর্তমান।

ফ্লুরাইডঘটিত জল দূষণের পরিণতি :

পানীয় জলের প্রতি লিটারে 0.5-1.0mg ফ্লুরাইডের উপস্থিতি
দাতের পক্ষে উপযোগী। কিন্তু অধিক পরিমাণ ফ্লুরাইড থাকলে দাঁতের ও হাড়ের ক্যালশিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া করে
অদ্রাব্য CaF2 গঠনের মাধ্যমে দাঁত ও হাড়কে ভঙ্গুর করে দেয় এবং মেরুদণ্ডের নমনীয়তা হ্রাস পায়। একে বলে ফ্লুরোসিস রোগ। দীর্ঘদিন ধরে ফ্লুরাইডযুক্ত জল পান করতে থাকলে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয়, শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস পায় ও বুক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ফ্লুরাইড দূষণ মোকাবিলা করার পদ্ধতি :

1. জলে খুব বেশিমাত্রায় ফ্লুরাইড থাকলে এই জলকে সক্রিয় অ্যালুমিনা নির্মিত স্তম্ভের মধ্যে দিয়ে পাঠালে ফ্লুরাইড লবণগুলো অনেকটাই দূরীভূত হয়।

2. ফ্লুরাইডযুক্ত জলে চুন ও ফটকিরি ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা স্থিরভাবে রেখে দেওয়া হয়। এরপর থিতিয়ে যাওয়া জলকে পরিস্রাবণ করে নিলে বেশ কিছুটা ফ্লুরাইড লবণ দূরীভূত হয়।

আরও পড়ুন : পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ‍্য

Leave a Comment