ভাইরাস কাকে বলে ? ভাইরাসের আবিষ্কার, প্রকৃতি, উৎপত্তি, অবস্থান, আকার এবং বৈশিষ্ট্য

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

ভাইরাস কাকে বলে – what is Virus : সুপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা আজকের এই পর্বটিতে আলোচনা করলাম ভাইরাস কাকে বলে ? ভাইরাসের আবিষ্কার ? ভাইরাসের প্রকৃতি, উৎপত্তি, অবস্থান, আকার এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। চলুন দেখে নেওয়া যাক ভাইরাস কাকে বলে

ভাইরাস কাকে বলে ? ভাইরাসের আবিষ্কার, প্রকৃতি, উৎপত্তি, অবস্থান, আকার এবং বৈশিষ্ট্য

ভাইরাস শব্দের অর্থ :

ভাইরাস কাকে বলে জানার পূর্বে ভাইরাস শব্দের অর্থ জানা দরকার। 

ভাইরাস (virus) একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ ‘বিষ’ (poison)। ভাইরাস একপ্রকার জৈবকণা যা কেবল সজীব কোশেই নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করতে পারে। সজীব কোশের বাইরে এরা জড়ের মতো আচরণ করে। তাই এদের জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ের বস্তু বলা হয়। ভাইরাসের একককে ভিরিয়ন বলে। ভাইরাস এত ক্ষুদ্র যে কেবলমাত্র 2A রেজুলুশন ক্ষমতা সম্পন্ন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে এরা দৃশ্যমান।

1892 খ্রিস্টাব্দে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি এ. আইভানোস্কি (Dmitri A. Iwanovski) তামাক পাতার মোজাইক রোগের কারণ হিসেবে এমন এক সংক্রমণ বস্তুর কথা উল্লেখ করেছিলেন যা ব্যাকটেরিয়ার থেকেও ছোটো এবং ব্যাকটেরিয়া-ফিলটার দ্বারা ছাঁকা তরল পদার্থের মধ্যে থেকেও ওই রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। 1898 খ্রিস্টাব্দে ডাচ্ বিজ্ঞানী বেইজেরিঙ্ক (M. W. Beijerinck) প্রথম ‘ভাইরাস’ নামটি প্রবর্তন করেন

◆ ভাইরাস কাকে বলে :

নিউক্লিয় প্রোটিন নির্মিত, অতি ক্ষুদ্র, অকোশীয়, রোগসৃষ্টিকারী, বাধ্যতামূলক পরজীবী, কেবলমাত্র পোষককোশে প্রজননক্ষম, ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দৃশ্যমান জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ের বস্তুকে ভাইরাস বলে।

◆ ভাইরাস আবিষ্কার :

● ক্যারোলাম ক্লসিয়াস (1576) : টিউলিপ ফুলের পাপড়ির বর্ণবৈচিত্র্য রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু যে ভাইরাস তা প্রথম ধারণা দেন।

● ড. জেনার (1796) : সর্বপ্রথম ভাইরাস আক্রান্ত বসন্ত রোগের প্রতিরোধক হিসেবে টিকা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।

● রবার্ট কক্ (1876) ও লুই পাস্তুর (1880 ) : হাম, বসন্ত, জলাতঙ্ক, মাম্পস ইত্যাদি রোগগুলি যে ভাইরাস আক্রান্ত তা প্রথম ব্যাখ্যা দেন।

● ডি. এ. আইভানোস্কি (1892) : সংক্রামক তামাক পাতার রস ব্যাকটেরিয়া ফিলটারে পরিশ্রুত করে সংক্রমণযোগ্য তরলের
সন্ধান পেয়েছিলেন।

● এম. ডব্লু বেইজেরিঙ্ক (1896 ) : সংক্রামিত তরলকে ‘ভাইরাস’ আখ্যা দেন এবং ওই তরলকে সংক্রামক জীবন্ত তরল পদার্থ’ বলে অভিহিত করেন।

● তাকাহাসি (1933 ) : তামাক পাতায় মোজাইক রোগের ভাইরাসের আকৃতি সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করেন।

● স্ট্যানলি (1935 ) : TMV ভাইরাসকে সর্বপ্রথম কেলাসিত করতে সমর্থ হন।

● বডেন এবং পিরি : 1937 খ্রিস্টাব্দে ভাইরাসকে ‘সংক্রামক নিউক্লিয় প্রোটিন অণু হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

● হার্সে ও চেস (1952) : ব্যাকটেরিওফাজের জেনেটিক মেটিরিয়াল যে DNA তা প্রমাণ করেন।

● লিন্ডম্যান (1957) : পোলিয়োর টিকা আবিস্কার করেন।

● ব্রেনার (1959) : T2 ফাজের গঠন বর্ণনা করেন।

● সাফারম্যান এবং মরিস (1963 ) : সায়ানোফাজ আবিষ্কার করেন। •

● ডিনার এবং রেমার (1967) : ভাইরয়েড আবিষ্কার করেন।

● র‍্যান্ডেল এবং সহকর্মীবৃন্দ (1981) : ভাইরুসয়েড আবিষ্কার করেন।

● গটলিব (1981 ) : HIV আবিষ্কার করেন।

● প্রুসনার (1982 ) : প্রিয়নস্ আবিষ্কার করেন।

◆ ভাইরাসের প্রকৃতি :

i. ভাইরাসের জীবনচক্রে দুটি দশা প্রধান-অন্তঃকোশীয় ও বহিঃকোশীয়। অন্তঃকোশীয় দশায় সজীব বস্তুর মতো আচরণ করে। বহিঃকোশীয় দশায় সংক্রমণযোগ্য নিষ্ক্রিয় জড় বস্তুর মতো আচরণ করে।
ii. বহিঃকোশীয় দশায় প্রতিটি ভিরিয়ন কণার সংক্রমণ ক্ষমতা বিদ্যমান।
iii. ভাইরাসের দেহে যে-কোনো একপ্রকার নিউক্লিক অ্যাসিড থাকে। ভাইরাসের ক্ষেত্রে DNA দ্বিতন্ত্রী বা একতন্ত্রী হতে পারে, আবার RNA একতন্ত্রী বা দ্বিতন্ত্রী হতে পারে।
iv. ভাইরাস পোষক কোশে প্রবেশের পর নিউক্লিক অ্যাসিডের সাহায্যে নিজেদের বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে।

v. ভাইরাস পোষক কোশ ছাড়া বংশবিস্তার করতে পারে না, তাই ভাইরাসকে বাধ্যতামূলক পরজীবী বলে।
vi. ভাইরাসে সাইটোপ্লাজম, রাইবোজোম এবং প্রোটিন সংশ্লেষ, বিপাকক্রিয়া অনুপস্থিত।
vii.ভাইরাসের মধ্যে স্বল্প দু-একটি উৎসেচকের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
viii.ভাইরাসের আয়তন বৃদ্ধি ঘটে না, উত্তেজনায় সাড়া দেয় না, চলন ক্ষমতা নেই।
ix. বিশুদ্ধ ভাইরাস কণাকে কেলাসিত করা যায়।
x. বহু বছর সংরক্ষণ করার পরেও ভাইরাসের সক্রিয়তা বজায় থাকে।

◆ ভাইরাসের উৎপত্তি :

ভাইরাসের গঠনগত দুটি মুখ্য উপাদান হল প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিড। এর থেকে অনুমান করা যায় যে ভাইরাসের উৎপত্তি জৈব অভিব্যক্তির পথেই ঘটেছে। বিজ্ঞানীদের মতে ভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কিত তিনটি মতবাদ প্রচলিত আছে।

1.অকোশীয় মতবাদ : জৈব বিবর্তনের পথে কোশ উৎপত্তির সমসাময়িককালে ভিন্ন পথ ধরে অকোশীয় কোনো বস্তু থেকে ভাইরাসের উৎপত্তি ঘটেছে।

2. পরজীবী মতবাদ ঃ এই মতবাদ অনুসারে ভাইরাস প্রথমে কোশীয় জীব ছিল কিন্তু দীর্ঘকাল যাবৎ পরজীবী হিসেবে বাস করার জন্য তাদের মধ্যে পরিবর্তন ও সরলীকরণ ঘটায় বর্তমানের ভাইরাসের উৎপত্তি ঘটেছে।

3. প্রজনন মতবাদ : কোশের প্রজনন বস্তুর খণ্ডাংশ থেকে উৎপত্তি হয়ে ভাইরাস দ্রুত বংশবিস্তার করে এবং সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটায়। ফলে কোশের মৃত্যু ঘটে এবং ভাইরাস বাইরে চলে আসে।

◆ ভাইরাসের অবস্থান :

ভাইরাস জল, মাটি, বায়ু সর্বত্রই অবস্থান করে। এরা বিভিন্ন
গোষ্ঠীভুক্ত উদ্ভিদ (শৈবাল, ছত্রাক, ফার্ন, ব্যক্তবীজী ও গুপ্তবীজী) ও প্রাণীদেহে (আদ্যপ্রাণী, পতঙ্গ, মাছ, উভচর, পক্ষী, স্তন্যপায়ী ও মানুষ) পূর্ণ পরজীবীরূপে বাস করে এবং মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। পোষক কোশের বাইরে নিষ্ক্রিয় জড় বস্তু রূপে অবস্থান করে এবং ভিতরে সক্রিয় ও সজীব হয়ে ওঠে।

◆ ভাইরাসের আকার :

1. গোলাকার : এই প্রকার ভাইরাস প্রধানত গোলাকার হলেও পরস্পরের মধ্যে স্বল্প আকৃতিগত তারতম্য দেখা যায়। রাইনোভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিয়ো, টিউমার, এনকেফালাইটিস প্রভৃতি রোগের ভাইরাস গোলাকার। এদের ব্যাস 10 – 250 nm পর্যন্ত হয়।

2. দণ্ডাকার : টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV), আলুর ব্লাইট, আলফা আলফা মোজাইক ভাইরাস প্রভৃতি দণ্ডাকার ভাইরাস। এদের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে 300nm এবং 18 nm এর মধ্যে হয়।

3. ঘনকাকার : ভ্যাকসিনিয়া, ভ্যারিওলা প্রভৃতি বসন্ত রোগের ভাইরাস, হারপিস ভাইরাস এই আকৃতি বিশিষ্ট। এদের আয়তন সাধারণত 100-350nm হয়।

4. শুক্রাণু বা ব্যাঙাচি আকার : ব্যাকটেরিয়া আক্রমণকারী ফাজ ভাইরাস T2 বা T4 এই আকৃতি বিশিষ্ট। এদের দেহ মস্তক, গ্রীবা ও পুচ্ছ অংশ নিয়ে গঠিত। মস্তক সাধারণত 95 × 65 nm এবং পুচ্ছ 110 × 25 nm আয়তনের হয়।

◆ ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য :

i. ভাইরাস অতি সূক্ষ্ম, রোগসৃষ্টিকারী, বাধ্যতামূলক পরজীবী।

ii. ভাইরাস জীব ও জড়ের উভয় বৈশিষ্ট্য বহনকারী অকোশীয় জীব।

iii. এরা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট পোষক কোশে প্রজননক্ষম, পোষক কোশের বাইরে জড়ের মতো আচরণ করে।

iv. ভাইরাস প্রোটিন নির্মিত বহিরাবরণ (ক্যাপসিড) ও কেন্দ্রস্থ নিউক্লিক অ্যাসিড নিয়ে গঠিত।

v. ভাইরাস দেহে DNA অথবা RNA যে-কোনো একপ্রকার নিউক্লিক অ্যাসিড থাকে।

vi. ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া-ফিলটারে পরিস্রাব্য এবং কেবলমাত্র ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায়।

vii. নিউক্লিয় প্রোটিন নির্মিত ভাইরাস কণাকে কেলাসিত করা সম্ভব।

viii. এদের দেহে শ্বসন ও বিপাক ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না।

ix. ভাইরাসের দেহ উৎসেচকবিহীন অথবা স্বল্প কয়েকটি উৎসেচক থাকে।

x. প্রাণী ভাইরাসের দেহে ক্যাপসিডের বাইরে শর্করা, প্রোটিন ও লিপিড নির্মিত বহিরাবরণ (এনভেলপ) থাকে ।

xi. অভিযোজন ও পরিব্যক্তি ক্ষমতা এদের সজীবতার অন্যতম লক্ষণ।

xii. এরা অ্যান্টিজেন হিসেবে কাজ করে এবং পোষক কোশে প্রবেশ করে অ্যান্টিবডি উৎপাদনে সাহায্য করে।

xiii. ভাইরাসের বৃদ্ধি হয় না, নিজস্ব বিভাজন ক্ষমতা নেই।

xiv. কৃত্রিম মাধ্যমে এদের বৃদ্ধি ঘটে না, পরীক্ষাগারে পোষক কোশ পালন করে এদের সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

xv. এরা উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের রোগ সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন :

পরিবেশ দূষণ কাকে বলে ? 

শিলা কাকে বলে ?

9 thoughts on “ভাইরাস কাকে বলে ? ভাইরাসের আবিষ্কার, প্রকৃতি, উৎপত্তি, অবস্থান, আকার এবং বৈশিষ্ট্য”

Leave a Comment