শৈবাল কাকে বলে – What is Algae : সুপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা আজকের এই পর্বটিতে তোমাদের সাথে শেয়ার করলাম শৈবাল কাকে বলে ? শৈবালের শ্রেণীবিভাগ ? শৈবালের বৈশিষ্ট্য এবং শৈবালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে।
◆ শৈবাল কাকে বলে :
ক্লোরোফিলযুক্ত, আদি নিউক্লিয়াস বা আদর্শ নিউক্লিয়াসযুক্ত, স্বভোজী পুষ্টিসম্পন্নকারী, সমাঙ্গদেহী সরল প্রকৃতির উদ্ভিদদের শৈবাল বলে।
◆ শৈবালের শ্রেণিবিভাগ :
বহুকোশী শৈবালদের তিনটি মুখ্য বিভাগ হল-লাল শৈবাল, বাদামি শৈবাল এবং সবুজ শৈবাল ।
A. লাল শৈবাল কাকে বলে ( বিভাগ-রোডোফাইটা ) :
রোডোফাইটা বিভাগের অন্তর্গত শৈবালদের লাল শৈবাল বলে। কারণ এদের দেহে বিশেষ রঞ্জক r-ফাইকোএরিথ্রিন থাকে।
● লাল শৈবালের বৈশিষ্ট্য :
1. লাল শৈবাল সবচেয়ে প্রাচীন, জীবিত প্রজাতির সংখ্যা প্রায় 5000 ।
2. এরা সাধারণত সামুদ্রিক,একমাত্র স্বাদুজলে বসবাস করে।
3. লাল শৈবাল মূলত স্বভোজী। কয়েকটি প্রজাতি পরজীবী।
4. এদের জীবন চক্রে সচল ফ্ল্যাজেলাযুক্ত দশা থাকে না।
5. উদ্ভিদ দেহ এককোশী, সূত্রাকার , ফিতাকৃতি , প্যারেনকাইমাটাস, সিউডোপ্যারেনকাইমাটাস, বহুকোশী প্রকারের হয়।
6. কোশপ্রাচীর সেলুলোজ, পেকটিক পদার্থ এবং মিউকোপলিস্যাকারাইড দিয়ে গঠিত।
7. দেহকোশে সালোকসংশ্লেষীয় অঙ্গাণু—ক্রোমাটোফোর থাকে।
৪. দেহকোশে সালোকসংশ্লেষীয় রঞ্জক— ক্লোরোফিল- a, ক্যারোটিনয়েড, ফাইকোবিলিন থাকে। ফাইকোবিলিন তিন প্রকারের হয় যথা—অ্যালোফাইকোসায়ানিন, r-ফাইকোসায়ানিন ও r-ফাইকোএরিথ্রিন।
9. কোশের সঞ্চিত খাদ্য হল – ফ্লোরিডিয়ান শ্বেতসার যা গ্লাইকোজেন সদৃশ।
10. অযৌন জনন সম্পন্ন হয় রেণুর সাহায্যে। রেণু বিভিন্ন প্রকারের, যথা—নিউট্রাল স্পোর, মনোস্পোর, টেট্রাস্পোর, কারপোস্পোর, গেমি ইত্যাদি।
11. যৌন জনন উগ্যামাস প্রকৃতির পুংজনন অঙ্গ হল স্পার্মাট্যাঞ্জিয়াম বা অ্যানথেরিডিয়াম এবং স্ত্রী জনন অঙ্গ হল- কারপোগোনিয়াম।
12. বহুকোশী লাল শৈবালদের জনুক্রম দেখা যায়।
B. বাদামি শৈবাল কাকে বলে ( বিভাগ-ফিওফাইটা ) :
ফিওফাইট বিভাগের অন্তর্গত শৈবালদের বাদামি শৈবাল বলে। এদের দেহে বাদামি বর্ণের রঞ্জক ফিউকোজ্যানথিন থাকে। অ্যাটলানটিক সমুদ্রে এদের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
● বাদামি শৈবালের বৈশিষ্ট্য :
1. বাদামি শৈবালের প্রজাতি সংখ্যা প্রায় 2000 ।
2. বেশিরভাগ বাদামি শৈবাল সামুদ্রিক।
3. এই শৈবাল এককোশী হয় না।
4. নিম্নশ্রেণির শৈবালরা শাখান্বিত সূত্রাকার গঠনযুক্ত এবং উচ্চশ্রেণির শৈবালরা প্যারেনকাইমাটস গঠনযুক্ত হয়।
5. সবচেয়ে বড়ো বাদামি শৈবালদের কেল্প বলে। বৃহত্তম কেল্প হল Macrocystis ( 40-100 cm)।
6. উদ্ভিদদেহ তিন ভাগে বিভক্ত, যথা—i. হোল্ডফাস্ট যার সাহায্যে এরা সমুদ্রের তলদেশে আটকে থাকে। ii. কাণ্ডের মতো দেহ বা স্টাইপ । iii. চ্যাপ্টা পত্রসদৃশ ল্যামিনা ।
7. বৃহৎ বাদামি শৈবালদের দেহে বায়ু গহ্বর বা ব্লাডার থাকে।
৪. কোশপ্রাচীরে সেলুলোজ, ননগ্লুকান স্যাকারাইড এবং ফাইকোকোলয়েড থাকে।
9. বাদামি শৈবালের ফাইকোকোলয়েড অ্যালজিনিক অ্যাসিড, ফিউকয়ডিন এবং ফিউসিন নিয়ে গঠিত।
10. সালোকসংশ্লেষীয় অঙ্গাণু ক্রোমাটোফোর তিনটি ফাইলাকয়েড ল্যামেলি নিয়ে গঠিত।
C. সবুজ শৈবাল কাকে বলে ( বিভাগ-ক্লোরোফাইটা ) :
সকল প্রকার সবুজ শৈবাল ক্লোরোফাইট বিভাগের অন্তর্গত। স্থলজ উদ্ভিদের মতো এদের কোশপ্রাচীর সেলুলোজ দিয়ে গঠিত। সঞ্চিত খাদ্য হিসেবে শ্বেতসার উপস্থিত। সালোকসংশ্লেষীয় রঞ্জক হিসেবে ক্লোরোফিল-a ও ক্লোরোফিল-b বিদ্যমান।
● সবুজ শৈবালের বৈশিষ্ট্য :
1. সবুজ শৈবালের জীবিত প্রজাতির সংখ্যা প্রায় 7000 ।
2. সবুজ শৈবালরা সবরকম পরিবেশে বসবাস করে। শতকরা 10 ভাগ শৈবাল সামুদ্রিক, বেশিরভাই স্বাদু জলে বসবাস করে। এছাড়া ভিজে মাটি, পাথর, গাছের গুঁড়ি ইত্যাদি স্থানেও এদের দেখা যায়। উষ্ণ জলে এবং বরফ জলে বসবাস করে।
3. এরা এপিফাইটিক, এন্ডোফাইটিক, এপিজোইক, এন্ডোজোইক প্রকৃতির হয়। জুক্লোরেল্লা স্পঞ্জের উপরে, ফ্রাস্টোসিয়ানদের এবং মোলাস্কান প্রাণীদের খোলকের উপর জন্মায়।
4. থ্যালাস এককোশী ফ্ল্যাজেলাযুক্ত, এককোশী ফ্ল্যাজেলাবিহীন, ফ্ল্যাজেলাযুক্ত উপনিবেশ গঠনকারী, ফ্ল্যাজেলাবিহীন উপনিবেশ গঠনকারী, বহুকোশী সূত্রাকার, সিনোসাইটিক, প্যারেনকাইমাটাস
ইত্যাদি প্রকারের হয়।
5. কোশপ্রাচীরে সেলুলোজ উপস্থিত।
6. ক্লোরোপ্লাস্টে 2-20টি থাইলাকয়েড ল্যামেলি থাকে।
7. সালোকসংশ্লেষীয় রঞ্জক হল – ক্লোরোফিল-a । ক্লোরোপ্লাস্টে 1 থেকে অনেক পাইরিনয়েড দানা উপস্থিত। সজ্জিত খাদ্য শ্বেতসার।
৪. ফ্লাজেলাযুক্ত শৈবালদের ক্লোরোপ্লাস্টের মধ্যে চক্ষু বিন্দু বা স্টিগমা উপস্থিত।
9. অযৌন জনন জুস্পোর, অ্যাপ্লানোস্পোর, অ্যাকাইনেট, অটোস্পোরের সাহায্যে সম্পন্ন হয়। যৌন জনন আইসোগ্যামি, অ্যানাইসোগ্যামি ও ঊগ্যামি প্রকৃতির।
◆ শৈবালের সাধারণ বৈশিষ্ট্য :
1. উদ্ভিদজগতে স্থান : শৈবাল থ্যালোফাইটা বা সমাঙ্গদেহী বিভাগের অন্তর্গত ক্লোরোফিলযুক্ত স্বভোজী উদ্ভিদ।
2. বাসস্থান : শৈবাল মুখ্যত জলজ উদ্ভিদ। তবে এদের অর্ধজলজ ও স্থলজ হিসেবেও জন্মাতে দেখা যায়। শৈবাল অনেকসময় মিথোজীবীরূপে ছত্রাকের সঙ্গে সহাবস্থান করে। যেমন—লাইকেন।
3. দেহগঠন : শৈবাল এককোশী (ক্ল্যামাই- ডোমোনাস), বহুকোশী, শাখাহীন বা শাখান্বিত সূত্রাকার (স্পাইরোগাইরা) হয়। কোনো কোনো শৈবাল ফাঁপা নলের মতো বা উপনিবেশ গঠনকারী (ভলভক্স) হয়। একসারি শৈবাল কোশকে ট্রাইকোম বা রুহ বলে। ট্রাইকোম যখন পিচ্ছিল পদার্থের আবরণে আবৃত থাকে, তখন তাকে অণুসূত্র বা ফিলামেন্ট বলে। এককোশী শৈবালরা অনেকক্ষেত্রে ফ্ল্যাজেলাবিশিষ্ট হয়।
4. কোশের প্রকৃতি : শৈবালের কোশ প্রো- ক্যারিওটিক (নীলাভ-সবুজ শৈবাল) বা ইউ- ক্যারিওটিক প্রকৃতির হয়। কোশে কোশপ্রাচীর থাকে। কোশের সাইটোপ্লাজমে আদর্শ নিউক্লিয়াসসহ বিভিন্নরকম কোশ-অঙ্গাণু থাকে।
5. কোশপ্রাচীর : শৈবালের কোশ সাধারণত দু-স্তরবিশিষ্ট কোশপ্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত থাকে। কয়েকটি ফ্ল্যাজেলাযুক্ত শৈবালের কোশে কোশপ্রাচীর থাকে না। এদের কোশে পেরিপ্লাস্ট নামক দৃঢ় আবরণ থাকে। শৈবালের কোশপ্রাচীরে সেলুলোজ, পেকটিন ও মিউসিলেজ জাতীয় কার্বোহাইড্রেট থাকে। কোশপ্রাচীরে অনেকসময় প্রোটিন জমা থাকে।
৪. সঞ্চিত খাদ্যবস্তু : শৈবালের কোশে সঞ্চিত প্রধান খাদ্যবস্তু হল কার্বোহাইড্রেট। এ ছাড়া স্নেহপদার্থ, লিউকোসিন, প্যারামাইলাম ইত্যাদি পদার্থ সঞ্চিত খাদ্যরূপে অবস্থান করে। শৈবালে কার্বোহাইড্রেট বিভিন্ন প্রকারের হয়, যেমন—সবুজ শৈবালে শ্বেতসার, বাদামি শৈবালে ম্যানিটল ও ল্যামিনারিন, সোনালি-বাদামি শৈবালে ডায়াটমিন, নীলাভ-সবুজ শৈবালে সায়ানোফাইসিয়ান শ্বেতসার ইত্যাদি।
9. জনন : শৈবালের জনন অঙ্গজ, অযৌন ও যৌন জনন পদ্ধতিতে হয়। এদের অঙ্গজ জনন খণ্ডীভবন পদ্ধতিতে ঘটে। এদের অযৌন জনন রেণুর সাহায্যে ঘটে। এদের যৌন জনন তিন রকমের, যেমন—অ্যানাইসোগ্যামি, আইসোগ্যামি ও ঊগ্যামি প্রকৃতির হয়। এদের সংযুক্তি পদ্ধতিতেও যৌন জনন সম্পন্ন হয়।
◆ শৈবালের প্রধান বৈশিষ্ট্য :
i. শৈবাল ক্লোরোফিলযুক্ত স্বভোজী, সমাঙ্গদেহী উদ্ভিদ।
ii. শৈবাল এককোশী, বহুকোশী, প্রোক্যারিওটিক ও ইউক্যারিওটিক প্রকৃতির হয়।
iii. শৈবালের কোশপ্রাচীর দু-স্তরবিশিষ্ট এবং মুখ্যত সেলুলোজ ও পেকটিন দিয়ে গঠিত।
iv. শৈবালের কোশে অবস্থিত ক্লোরোপ্লাস্ট ডিম্বাকার, ফিতাকৃতি, পেয়ালাকার, তারকাময়, প্যাঁচানো আকৃতিবিশিষ্ট হয়।
v. শৈবালের ক্লোরোপ্লাস্টে পাইরিনয়েড দানা থাকে।
উদাহরণ : 1. স্পাইরোগাইরা 2. ভলভক্স 3. ক্ল্যামাইডোমোনাস 4.কারা 5. ফিউকাস ।
◆ শৈবালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব :
1. খাদ্যরূপে : অতি প্রাচীনকাল থেকেই শৈবাল মানুষের খাদ্যরূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চিনদেশে গ্রাসিলেরিয়া ও ল্যামিনেরিয়া, জাপানে পরফাইরা, স্কটল্যান্ডে উলভা খাদ্য হিসেবে প্রচলিত। বর্তমানে ক্লোরেল্লা থেকে ভিটামিন প্রস্তুতি এবং অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করা হচ্ছে।
2. ওষুধরূপে : ক্লোরেল্লা থেকে ক্লোরেলিন নামক জীবাণুপ্রতিরোধী ওষুধ তৈরি হয়। ল্যামিনেরিয়া ও সারগাসাম থেকে গলগণ্ড রোগের ওষুধ তৈরি করা হয়।
3. শিল্পে ব্যবহার : সমুদ্র শৈবাল থেকে যে ‘কেল্প’ পাওয়া যায় তা কাচ ও সাবান শিল্পে ব্যবহৃত হয়। বাদামি শৈবাল থেকে আলজিন
এবং লোহিত শৈবাল থেকে যে জিলাটিন পাওয়া যায় তা জেলি, আইসক্রিম ও প্রসাধন শিল্পে ব্যবহার করা হয়। কেল্প থেকে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন, সোডা, পটাশ এবং অ্যালজিনিক অ্যাসিড পাওয়া যায়।
4. পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস উৎপাদন : সামুদ্রিক শৈবাল থেকে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায়।
5. আবর্জনা শোধনে : নালা-নর্দমার আবর্জনা শোধনে শৈবাল ব্যবহৃত হয়।
6. সার হিসেবে : নীলাভ-সবুজ শৈবাল অ্যানাবিনা, নস্টক, অসিলেটোরিয়া জমির নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। অনেক সামুদ্রিক শৈবাল পটাশিয়ামের চাহিদা পূরণ করে।
7. মহাকাশ গবেষণায় : ক্লোরেল্লা মহাকাশযানে রাখা হয় যা মহাকাশযানে অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে।
৪. মৎস্যচাষ : মাছ চাষে বিভিন্ন শৈবালকে মাছের খাদ্যরূপে ব্যবহার করা হয়।
9. ডায়াটমীয় মৃত্তিকা : সমুদ্রে জলের নীচে ডায়াটম শৈবালের মৃতদেহ দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত জমা হয়ে বিশেষ একপ্রকার শক্ত মৃত্তিকা গঠন করে, একে ডায়াটমীয় মৃত্তিকা বলে। এটি ব্লাস্ট ফার্নেসের তাপ নিরোধক আস্তরণ, বিস্ফোরক পদার্থ, ফিলটার প্রভৃতি তৈরিতে কাজে লাগে।
10. পশুখাদ্য হিসেবে : সারগাসাম, ল্যামিনেরিয়া, ফিউকাস প্রভৃতি সামুদ্রিক শৈবাল গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে এবং পোলট্রিতে হাঁস, মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়।
11. আগার আগার : জেলিডিয়াম, গ্রাসিলেরিয়া প্রভৃতি সামুদ্রিক লোহিত শৈবাল থেকে আগার আগার তৈরি হয়। এটি পরীক্ষাগারে কৃত্রিম অনুশীলন মাধ্যম তৈরিতে ও কয়েক প্রকার খাদ্যবস্তু তৈরিতে কাজে লাগে।
6 thoughts on “শৈবাল কাকে বলে ? শৈবালের শ্রেণীবিভাগ, বৈশিষ্ট্য ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব | What is Algae”