আবহবিকার কাকে বলে ? What is Weathering | আবহবিকারের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ এবং যান্ত্রিক, রাসায়নিক, জৈবিক আবহবিকার কাকে বলে

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

আবহবিকার কাকে বলে ? What is Weathering | আবহবিকারের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ

আবহবিকার কাকে বলে ? What is Weathering : আজকের টপিক আবহবিকার থেকে আবহবিকার কাকে বলে ? আবহবিকারের বৈশিষ্ট্য ? আবহবিকারের প্রকারভেদ সম্পর্কে চলুল তাহলে দেখে নেওয়া যাক আজকের মূল আলোচনা।

আবহবিকার কাকে বলে :

আবহাওয়ার উপাদান গুলি দ্বারা যেমন (উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত) কোন শিলার নিজ স্থানে চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া বা বিরোজিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় আবহবিকার।

আবহবিকারের নামকরণ :

আবহাওয়ার উপাদান দ্বারা শিলার ‘ বিকার ’ বা ‘ পরিবর্তন ’ ঘটে বলে এরূপ নামকরণ হয়েছে ।

আবহবিকার কত প্রকার ও কি কি :

আবহবিকার মূলত তিন প্রকার। যথা- 1.যান্ত্রিক ( শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয় ) 2. রাসায়নিক ( শিলার বিয়োজন হয় ) 3. জৈবিক ( উদ্ভিদ ও প্রাণীর দ্বারা শিলার পরিবর্তন হয় )।

আবহবিকারের বৈশিষ্ট্য :

i. আবহবিকার শিলার বিচূর্ণন ও বিয়োজন ঘটে ।

ii. এটি একটি স্থিতিশীল প্রক্রিয়া ।

iii শিলাচুর্ণের অপসারণ হয় না ।

iv. আবহবিকারের শক্তি শিলার গঠন , প্রকৃতি ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল ।

আবহবিকারের ফলাফল :

i.গোলাকৃতি পাহাড় , ইনসেলবার্জ , টর , গুহা প্রভৃতি ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়।

ii. মৃত্তিকা সৃষ্টিতেও আবহবিকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ

যান্ত্রিক আবহবিকার কাকে বলে :

উয়তা , বৃষ্টিপাত , তুষারপাত প্রভৃতি আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে , ভূপৃষ্ঠের শিলাসমূহ , সেই স্থানেই চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে যান্ত্রিক আবহবিকার ( physical weathering ) । যান্ত্রিক আবহবিকারের মাধ্যমে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হলেও উপাদানগুলির বৈশিষ্ট্যের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন প্রক্রিয়া :

যান্ত্রিক আবহবিকারের মূল প্রক্রিয়াগুলি নিম্নরূপ-

1. প্রস্তরচাঁই খণ্ডীকরণ :

উয়তার প্রভাবে শিলাস্তর যখন চাঁই বা ব্লকের মতো বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত হয় , তখন তাকে প্রস্তরচাঁই খণ্ডীকরণ ( Block Disintegration ) বলে।

a.পদ্ধতি : শিলা তাপের কুপরিবাহী হওয়ায় সূর্যের তাপে যখন শিলার বাইরের স্তর ও ভেতরের স্তরের মধ্যে প্রসারণের পার্থক্য ঘটে , তখন শিলাস্তরে সৃষ্ট অনুভূমিক ও উল্লম্ব ফাটল বরাবর একাধিক খণ্ডে শিলাস্তর ভাগ হয়ে যায়।

b. বৈশিষ্ট্য : i. ব্যাসল্ট শিলায় বেশি দেখা যায়। ii .শিলাস্তরে অনুভূমিক ও উল্লম্বভাবে একাধিক ফাটল সৃষ্টি হয়। iii.এই ধরনের আবহবিকারের ফলে শিলার চৌকাকারে বিচূর্ণন ঘটে।

c. অবস্থান : অধিক উন্নতাযুক্ত অঞ্চলে দেখা যায়।

2. শল্কমোচন :

শল্ক ’ শব্দের অর্থ বাকল । উয়তার প্রভাবে শিলাস্তর বাকলের মতো খুলে যায় ও বিচূর্ণিত হয় । এই প্রক্রিয়াকে শল্কমোচন ( Exfoliation ) বলে।

a. পদ্ধতি : সমসত্ব শিলার ভেতর ও বাইরের অংশের মধ্যে উয়তার প্রভাবে প্রসারণ (দিনের বেলায়) ও সংকোচন (রাত্রিবেলায়) সমান না হওয়ায় ওপরের শিলাস্তর পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো মূল শিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়।

b. বৈশিষ্ট্য : i. গ্র্যানাইট শিলায় বেশি দেখা যায়। ii .এই ধরনের আবহবিকারের ফলে উচ্চভূমির মাথাগুলি গোলাকার হয়। iii. সমসত্ব শিলায় এই ধরনের আবহবিকার ঘটে।

c. অবস্থান : সাহারা , থর প্রভৃতি উয় মরু অঞ্চলে শঙ্কমোচন প্রক্রিয়া বেশি দেখা যায়।

3. ক্ষুদ্রকণা বিশরণ :

উষ্ণতার হ্রাসবৃদ্ধির ফলে শিলাস্তরে প্রসারণ ও সংকোচন হওয়ায় শিলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ক্ষুদ্র বিশরণ (Granular Disintegration) বলে।

a. পদ্ধতি : বিসমসত্ত্ব শিলায় খনিজ গুলির তাপ গ্রহণ ও বর্জন আলাদা হওয়ায় পৃথক প্রসারণ ও সংকোচন এর ফলে শিলাস্তর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।

b. বৈশিষ্ট্য : i. বিসমসত্ব শিলায় এই আবহবিকারের প্রক্রিয়া ঘটে থাকে। ii. শিলাস্তর ফাটলে বন্দুকের গুলি করার মতো শব্দ হয়।

c. অবস্থান : উষ্ণ মরুভূমি অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া বেশি পরিলক্ষিত হয়।

4. তুষার কার্য :

শীতল জলবায়ুতে তুষার কেলাসের দ্বারা শিলা বিচূর্ণ-বিচূর্ণ হয়।

a. পদ্ধতি : মরু অঞ্চল এবং শীতল পার্বত্য অঞ্চলে শিলাস্তরের ফাটলে জমা জল তাপ বিকিরণের ফলে তুষার কেলাসে পরিণত হলে আয়তন বেড়ে যায় এবং শিলার গায়ে চাপ পড়েও শিলা বিচূর্ণ হয়।

b. বৈশিষ্ট্য : i. তুষার কেলাস গঠনের মাধ্যমে অবহবিকার
ঘটে। ii. পর্বতের ঢালে শঙ্কু আকৃতির শিলা চূর্ণের সৃষ্টি হয়।

c.অবস্থান : শীতল জলবায়ু অঞ্চলে দেখা যায়।

5. অন্যান্য প্রক্রিয়া :

যান্ত্রিক আবহবিকারের অন্যান্য প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে লবণ কেলাস গঠন , ডার্ট ক্র্যাকিং , বোল্ডার ক্লিভিং , ভারযুক্ত হয়ে শিলার প্রসারণ , বৃষ্টির ফোটার আঘাত প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।

রাসায়নিক আবহবিকার কাকে বলে :

বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত অক্সিজেন , কার্বন ডাইঅক্সাইড , জলীয়বাষ্প প্রভৃতির প্রভাবে শিলাস্তরের নিজ স্থানে রাসায়নিকভাবে বিয়োজন ঘটলে বা গাঠনিক উপাদানগুলির বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটলে , তাকে রাসায়নিক আবহবিকার  (Chemical Weathering) বলে।

রাসায়নিক আবহবিকারের বিভিন্ন প্রক্রিয়া :

রাসায়নিক আবহবিকারের প্রধান প্রক্রিয়াগুলি নিম্নরূপ

1. জারণ :

বায়ুর অক্সিজেনের উপস্থিতিতে জলের দ্বারা শিলা মধ্যস্থিত খনিজের পরিবর্তন হওয়ার রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে জারণ   (oxidation) বলে।

a.পদ্ধতি : লৌহ অক্সাইডযুক্ত শিলায় , অক্সিজেনের উপস্থিতিতে জলের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় নতুন খনিজের সৃষ্টি হয় ও শিলার বিয়োজন ঘটে।

b. বিক্রিয়া : 4FeO + 3H2O + O2 ― 2Fe2O3 , 3H2O ( ফেরাস  ( জল ) ( অক্সিজেন ) ( সোদক ফেরিক অক্সাইড) অক্সাইড )

c.বৈশিষ্ট্য : i. যে কোনো জলে এই আবহবিকার ঘটতে পারে । ii. এর প্রভাবে লৌহযুক্ত শিলায় মরচে পড়ে।

2. অঙ্গারযোজন :

বায়ুর কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের উপস্থিতিতে জলের দ্বারা শিলা মধ্যস্থিত খনিজের পরিবর্তন হওয়ার রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে অঙ্গারযোজন (Carbonation)  বলে।

a. পদ্ধতি : বৃষ্টির জল , বাতাসের CO2 গ্যাসের সঙ্গে তৈরি করে অ্যাসিড মিশে কার্বনিক ( CO2 + H2O → H2CO3 ) , যা চুনাপাথরজাতীয় সহজ দ্রাব্য শিলার সঙ্গে বিক্রিয়া করে শিলার বিয়োজন ঘটায়।

b. বিক্রিয়া : CaCO3 + H2CO3→ Ca ( HCO3 ) 2

c. বৈশিষ্ট্য : i. বৃষ্টির জলে এই আবহবিকার বেশি ঘটে। ii. চুনাপাথরযুক্ত শিলায় বেশি সক্রিয়।

3. জলযোজন :

শিলা মধ্যস্থিত খনিজের সাথে জলের রাসায়নিক বিক্রিয়া ও শিলার বিয়োজনের প্রক্রিয়াকে জলযোজন (Hydration) বলে।

a. পদ্ধতি : কতকগুলি খনিজের জল শোষণ করার ক্ষমতা বেশি । রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় শিলা মধ্যস্থিত খনিজের সাথে জলের অণু যুক্ত হয়ে খনিজগুলি স্ফীত হয়ে যায় ও শিলার বিয়োজন ঘটে ।

b. বিক্রিয়া : 2Fe2O3 + 3H2O→2Fe2O3, 3H2O

c. বৈশিষ্ট্য : i.শিলাগঠনকারী খনিজগুলি আয়তনে বৃদ্ধি পায়। ii.জল শোষণে শিলা নমনীয় হয়। ii. সমধর্মী খনিজের সৃষ্টি হয়।

জৈবিক আবহবিকার কাকে বলে :

উদ্ভিদ ও প্রাণীর দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিলার বিয়োজন ও বিচূর্ণ ঘটলে তাকে জৈবিক আবহবিকার বলে। প্রায় সব ধরনের জলবায়ু অঞ্চলেই জীবগোষ্ঠী শিলার আবহবিকার ঘটতে সাহায্য করে।

জৈবিক আবহবিকার এর প্রধান প্রক্রিয়ার গুলি হল :

1. জৈব – যান্ত্রিক আবহবিকার :

a.প্রাণীর সাহায্যে :  মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণী যেমন-, কেঁচো , ইঁদুর , প্রেইরি কুকুর , শিয়াল , খরগোস , উইপোকা , বিভিন্ন মূষিক জাতীয় প্রাণী শিলাস্তরের মধ্যে গর্ত খুড়ে জৈব – যান্ত্রিক আবহবিকারে সাহায্য করে । এই সকল প্রাণীরা শিলাস্তরে এবং শিথিল পদার্থের মধ্যে গর্ত ও গুহা তৈরি করে । উইপোকা মাটি খুড়ে ভূপৃষ্ঠের নীচের স্তরের মাটি ও শিলা ভূপৃষ্ঠের ওপরের স্তরে নিয়ে এসে শিলার আবহবিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । মাটিতে বসবাসকারী প্রাণীরা তাদের নিশ্বাসের সাথে যে CO2 ত্যাগ করে তা মাটির অভ্যন্তরস্থ শিলা ও মাটির চরিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে মৃত্তিকার আবহবিকার ঘটায় । মানুষ খনিজ দ্রব্য উত্তোলন , কৃষিকাজ , রাস্তাঘাট নির্মাণ , অবিবেচনাপ্রসূত কার্যকলাপ প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে দ্রুত শিলার আবহবিকার ঘটাতে সাহায্য করে ।

b.উদ্ভিদের সাহায্যে : উদ্ভিদের শিকড় মাটির মধ্যে প্রবেশ করলে মাটিতে ফাটল সৃষ্টি হয় ও শিলাসমূহ চূর্ণবিচূর্ণ হয় । উদ্ভিদের শিকড় 175 ফুট পর্যন্ত মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারে । এর সাহায্যে শিলার যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটে । ঘন উদ্ভিদের আবরণ ভূমিভাগের কাছাকাছি অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে । মূলজ শ্বসন , হিউমাস , মাটির আর্দ্রতা , জৈব কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ , স্বল্প উন্নতা প্রভৃতি মাটিতে জৈব – যান্ত্রিক আবহবিকারে সহায়তা করে ।

2. জৈব – রাসায়নিক আবহবিকার :

a. শিলাস্তরের ওপরে জন্মানো লাইকেন পচে গিয়ে হিউমাস তৈরি করে । ওই হিউমাস মৃত্তিকায় অবস্থিত জলের সঙ্গে মিশে হিউমিক অ্যাসিডে পরিণত হয় , যা দ্রুত রাসায়নিক আবহবিকার ঘটায় ।

b. চুনাপাথর জাতীয় শিলাস্তরের মধ্যে যেসব প্রাণী বাস করে তাদের নিশ্বাসের সাথে নির্গত CO2 জলের সাথে মিশে কার্বনিক অ্যাসিডে পরিণত হয় । ওই অ্যাসিড চুনাপাথর বিক্রিয়া করে ।

c. উদ্ভিদের পাতা , ফুল , ফল , শিকড় , ডালপালা প্রভৃতি পচে গিয়ে যে অ্যাসিড তৈরি করে , তা থেকে শিলার আবহবিকার তরান্বিত হয় । উদ্ভিদের শিকড় প্রস্বেদনের সময় CO2 ত্যাগ করে যা মাটিতে অবস্থিত জলে দ্রবীভূত হয়ে কার্বনিক অ্যাসিড তৈরি করে এবং শিলার বিয়োজন ও বিচূর্ণন ঘটায়।

আরও পড়ুন : 

মালভূমি কাকে বলে ? সৃষ্টির কারণ, প্রকারভেদ,বৈশিষ্ট্য 

দ্রাঘিমা রেখা কাকে বলে ? বৈশিষ্ট্য 

বন‍্যা কাকে বলে ? বন‍্যার বৈশিষ্ট্য ও ব‍্যবহার 

বৃষ্টিপাত কাকে বলে ? শ্রেণীবিভাগ 

3 thoughts on “আবহবিকার কাকে বলে ? What is Weathering | আবহবিকারের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ এবং যান্ত্রিক, রাসায়নিক, জৈবিক আবহবিকার কাকে বলে”

Leave a Comment