ক্রিপস মিশন কি ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব, ব‍্যর্থতার কারণ এবং ভারতে আসার প্রতিক্রিয়া | What is Cripps Mission

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

ক্রিপস মিশন কি ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব, ব‍্যর্থতার কারণ এবং ভারতে আসার প্রতিক্রিয়া | What is Cripps Mission

ক্রিপস মিশন কি | What is Cripps Mission : আজকের পূর্ণাঙ্গ আলোচনার বিষয় হল ক্রিপস মিশন কি ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব গুলি কি ? ক্রিপস মিশনের ব‍্যর্থতার কারণ ? সম্পর্কে। প্রশ্নের উত্তর গুলি নিম্নরূপ।

ক্রিপস মিশন কি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে 1941 সালে জাপান অতর্কিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ করে । ফলস্বরূপ মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলি প্রবল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় । ইংল্যান্ডের উপনিবেশ হিসেবে ভারতেও জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে । এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য লাভের প্রত্যাশা করে এবং ভারতে এক দৌত্য প্রেরণ করে , যা ক্রিপস মিশন  (Cripps Mission) নামে পরিচিত।

জাপানের অতর্কিত আক্রমণে যুদ্ধক্ষেত্রে বিপর্যস্ত মিত্রশক্তির প্রধান রাষ্ট্র ইংল্যান্ড তার ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে । ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ – আলোচনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার 1942 সালে মার্চ মাসে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার বিশিষ্ট সদস্য ও খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস – কে ভারতে পাঠায় । ব্রিটিশ মহলে উদারনৈতিক কূটনীতিবিদ হিসেবে ক্রিপস – এর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল । তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল তাঁকেই এই যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূরীকরণের দায়িত্ব প্রদান করেন।

ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব :

1941 সালে জার্মান আক্রমণে মিত্রশক্তিভুক্ত দেশগুলি নাজেহাল হয়ে পড়ে । ইউরোপের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে তারা বারবার পর্যুদস্ত হয় । ভারতেও জাপানি আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেয় । এইরূপ পরিস্থিতিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ – আলোচনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য , বিশিষ্ট সমাজসেবী ও খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতে পাঠান । বিভিন্ন স্তরের ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ – আলোচনার পর তিনি একটি প্রস্তাব রাখেন ( 1942 খ্রিস্টাব্দের 29 মার্চ ) । এই প্রস্তাব ক্রিপস প্রস্তাব নামে
পরিচিত ।

ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব গুলি হল :

1. এই প্রস্তাবে বলা হয় যে , যুদ্ধের পর ভারতকে ‘ ডোমিনিয়ান ’ – এর মর্যাদা দেওয়া হবে।

2. যুদ্ধের পর ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে।

3. সংবিধান সভার সদস্যগণ প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত হবেন এবং দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা দেশীয় রাজাদের দ্বারা মনোনীত হবেন।

4. এই সংবিধান সভা ভারতের জন্য নতুন সংবিধান রচনা করবে।

5. ভারতের কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য এই সংবিধান গ্রহণে রাজি না হলে সেই প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য নিজস্ব সংবিধান রচনা করে নেবে।

6. সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর উপর ব্রিটিশ সরকার পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখবে।

7. বড়োলাটের কার্যনির্বাহী পরিষদে আপাতত ভারতীয় সদস্য বেশি সংখ্যায় নিয়োগ করা হবে।

ক্রিপস মিশন ভারতে আসার প্রতিক্রিয়া :

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ভারতে ক্রিপস মিশন আসে এবং এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্রিপস তাঁর প্রস্তাবের খসড়াপত্র পেশ করেন । এই খসড়া পেশের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি এবং ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে নানান ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

1. কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া : ক্রিপসের সঙ্গে আলোচনার সময়ে প্রথমে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল । কিন্তু জাতীয় সরকার গঠনের প্রশ্নে ক্রিপসের অনমনীয় মনোভাব এবং দেশবিভাজনের সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য এই আলোচনা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । কংগ্রেস এই প্রস্তাব বর্জন করলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিও ক্রিপস প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে । গান্ধিজি এই প্রস্তাবকে ‘ একটি ফেল পড়া ব্যাংকের অনুকূলে প্রদত্ত চেক ’ ( a post – dated cheque on a crashing bank ) বলে অভিহিত করেছেন।

2. মুসলিম লিগের প্রতিক্রিয়া : মুসলিম লিগ পাকিস্তান গঠনের প্রত্যাশায় ক্রিপস প্রস্তাবকে প্রাথমিক পর্যায়ে সমর্থন করে । কিন্তু স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র ‘ পাকিস্তান ’ গঠনের দাবি পূরণ না হওয়ায় তাদের এই আশা হতাশায় পর্যবসিত হয় । বিভিন্ন মুসলিম প্রদেশগুলিকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যুক্ত করা বা না করার বিষয় নিয়েও লিগের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলেছিল।

3. হিন্দু মহাসভার প্রতিক্রিয়া : হিন্দু মহাসভা ক্রিপস প্রস্তাবকে ভারত বিভাজনের পূর্বলক্ষণ বলে চিহ্নিত করেছিল , তাই পৃথক পাকিস্তান গঠনের আশঙ্কায় হিন্দু মহাসভা ক্রিপস প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে।

4. অ্যাংলো – ইন্ডিয়ানদের প্রতিক্রিয়া : অ্যাংলো – ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী ও খ্রিস্টান সমাজের নেতৃবর্গ মনে করতেন যে , ক্রিপস প্রস্তাব সংখ্যালঘু সমাজের জন্য কোনো ‘ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ’ – এর ব্যবস্থা করেনি।

5. শিখদের প্রতিক্রিয়া : শিখদের বাসভূমি পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিমরা । তাই শিখরা এটা ভেবে আতঙ্কিত ছিল যে , সম্পূর্ণ পাঞ্জাব যদি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে , তাহলে তাদের স্বার্থ তথা জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে।

ক্রিপস মিশন ব‍্যর্থতার কারণ :

একাধিক কারণে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়েছিল । ব্যর্থতার কারণগুলি নিম্নরূপ –

1. পূর্ণ স্বাধীনতার অভাব : এই প্রস্তাবে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের কোনো উল্লেখ ছিল না , আসলে ব্রিটিশ সরকার চায়নি ভারত স্বাধীনতা লাভ করুক । এটি ছিল লোক দেখানো কৌশল মাত্র।

2.সংবিধান সভাকেন্দ্রিক অভাব : এই প্রস্তাবে সংবিধান সভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগের কথা বলা হয়নি । ফলে ভারতীয়রা অসন্তুষ্ট হয়।

3. ভারত বিভাগের ইশারা : ক্রিপস মিশন কি ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব, ব‍্যর্থতার কারণ এবং ভারতে আসার প্রতিক্রিয়া | What is Cripps Mission এই প্রস্তাবে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটি কয়েকটি দেশীয় রাজ্যের ইচ্ছা – অনিচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল । সেজন্য কংগ্রেস এর বিরোধিতা করে । গান্ধিজি একে ‘ একটি ফেল পড়া ব্যাংকের অনুকূলে প্রদত্ত চেক ’ বলে নিন্দা করেছেন।

4. মুসলিম লিগের বিরোধ : ক্রিপসের প্রস্তাবে পৃথক পাকিস্তানের কথা বলা হয়নি । এর ফলে ভারতের মুসলিমরা হতাশ হয়ে পড়ে , মুসলিম লিগ ক্রিপসের প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করে।

5. ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে মতানৈক্য : ব্রিটিশ প্রশাসনের অনেকে ক্রিপসের বিরোধিতা করেছিলেন । তারা চাইতেন না যে ক্রিপস সফল হন । যেমন— চার্চিল , লিনলিথগো , ওয়াভেল প্রমুখ । তাঁদের বিরোধিতার জন্য ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়।

1942 খ্রিস্টাব্দের 11 এপ্রিল ক্রিপস একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন । ওই দিনের বেতারভাষণে তিনি কংগ্রেসকে এই ব্যর্থতার কারণে নানাভাবে দায়ী করেন । এপ্রিলের মাঝামাঝি ক্রিপস ইংল্যান্ডে ফিরে যান , পিছনে রেখে যান হতাশ ও ক্ষুব্ধ ভারতীয় জনগণকে । অধ্যাপক সুমিত সরকার লিখেছেন , ‘ অজস্র দ্বিমুখিতা আর ভুল বোঝাবুঝি ক্রিপস মিশনকে সর্বক্ষণ জর্জরিত করে আর শেষ অবধি ডুবিয়ে ছাড়ে।

আরও পড়ুন : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল

সার্কের উদ্দেশ্য, সমস্যা সাফল্য, 

ঠান্ডা লড়াইয়ে কারণ ও বৈশিষ্ট্য 

নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল

প‍্যালেস্টাইন সমস্যার কারণ

মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল

প্রশ্ন:

1. ক্রিপস মিশন ভারতে কবে আসে ?

উ: 1942 সালে 23 মার্চ

2. ক্রিপস মিশন কার আমলে ভারতে আসে ?

উ: স‍্যার স্ট‍্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে।

1 thought on “ক্রিপস মিশন কি ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব, ব‍্যর্থতার কারণ এবং ভারতে আসার প্রতিক্রিয়া | What is Cripps Mission”

Leave a Comment