রাওলাট আইন কি ? What is Rowlatt Act 1919 | রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য এবং শর্ত

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

রাওলাট আইন কি ? What is Rowlatt Act 1919 | রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য এবং শর্ত

রাওলাট আইন কি | What is Rowlatt Act 1919 : ভারতের ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকালে যে সকল দমনমূলক আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশ সরকারের জাতীয়তাবাদের দমন করতে চেয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আইন হল 1919 সালের এই রাওলাট আইন। আজকে আমরা জানবো রাওলাট আইন কি ? রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য ? রাওলাট আইনের শর্ত  ? সম্পর্কে। চলুন দেখে নেওয়া যাক।

রাওলাট আইন কি

রাওলাট আইন ( Rowlatt Act ) ছিল এক কঠিন দমনমূলক আইন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তীব্র আর্থিক সংকট যখন ভারতবাসীকে চরম দুর্দশার মুখে ঠেলে দিয়েছিল ঠিক সেই সময় থেকে ভারতের বৈপ্লবিক সশস্ত্র কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে । এই প্রেক্ষাপটেই ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক কর্মতৎপরতার প্রকৃতি অনুসন্ধান এবং তা দমনের জন্য ইংল্যান্ডের বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের (Sir Sidney Rowlatt) নেতৃত্বে 1919 সালে পাঁচ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয় । ওই বছরের মার্চ মাসে নৈরাজ্য এবং বৈপ্লবিক অপরাধ নামক দুটি আইন  (Anarchical and Revolutionary Crimes Act 1919) পাস হয় । সাধারণভাবে এই দুটি কুখ্যাত আইন একত্রে 1919 খ্রিস্টাব্দের রাওলাট আইন নামে পরিচিত

রাওলাট অ্যাক্টে বলা হয়েছিল যে জেলাশাসক এবং পুলিশের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং কারারুদ্ধ করা যাবে । এমনকি যে কোনো ব্যক্তির বাড়ি তল্লাশি চালানো যাবে । পাশাপাশি রাওলাট আইন বলবৎ করে ইংরেজ সরকার সংবাদপত্রের মতপ্রকাশের সকল প্রকার স্বাধীনতা হরণ করে নেয় এবং অপরাধীদের যথাযোগ্য শাস্তিপ্রদানের জন্য বিশেষ আদালতও গঠন করে । যে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা যেত না।

রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য

1919 সালে স্যার সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বে গঠিত দমনমূলক রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য বা  কারণগুলি বিদ্যমান ছিল সেগুলি হল-

রাওলাট আইনের অর্থনৈতিক কারণ :

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সাধারণ মানুষের কাছে চরম অভিশাপ ছিল , যা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের রাওলাট আইনের প্রেক্ষাপট রচনা করে দিয়েছিল । এর ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে অবনতি ঘটে তা হল-

1.দ্রব্যমূল্য বাড়ানো : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ফাটকাবাজি কারবারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে এবং মুদ্রাস্ফীতি চরমে উঠলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায় । ফলে তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায় ।

2. টাকার মূল্যমান হ্রাসপ্রাপ্ত : ভারতের ইংরেজ সরকার কাগজি নোট ছাপার ফলে মুদ্রাস্ফীতি চরমে উঠলে টাকার মূল্যমান হ্রাস পায় , পরিমাণস্বরূপ চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে এক অসম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

3. করভার বৃদ্ধি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন যুদ্ধঋণ বৃদ্ধি পায় তেমনি বৃদ্ধি পায় করভারও ( ৫০ % প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর ) । এইরূপ পরিস্থিতি ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোকে পঙ্গু করে তুলেছিল।

রাওলাট আইনের রাজনৈতিক কারণ :

রাওলাট আইনের জন্য যে সকল রাজনৈতিক কারণগুলি ছিল সেগুলি হল-

1. প্রতিরক্ষা আইনের মেয়াদ সমাপ্ত : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী গণ আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করলে ব্রিটিশ সরকার 1915 সালে ভারত রক্ষা আইন ( Defence of India Act , 1915 ) পাস করে । এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল । তীব্র দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলিকে কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করা । যুদ্ধোত্তরকালে এই আইনটির মেয়াদ । শেষ হলে তৎকালীন বিশৃঙ্খলময় পরিস্থিতিকে সামাল দিয়ে নিজেদের অবস্থানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইংরেজ সরকার ভারত রক্ষা আইনের মতো আরও একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে । এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই 1919 সালে ব্রিটিশ সরকার এই রাওলাট অ্যাক্ট পাস করেছিল।

2. মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষোভ সৃষ্টি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসলিম জগতের ধর্মগুরু তুরস্কের খলিফার পরাজয় ঘটলে ইংরেজ সরকার খলিফার শক্তি খর্ব করতে উদ্যত হয় । পরাজিত খলিফার শক্তি ক্ষয় করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার তুরস্কের ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে মনস্থির করে । ব্রিটিশ সরকারের এহেন পদক্ষেপে মুসলিম সম্প্রদায় তীব্র অপমানিত বোধ করে এবং তুরস্কের খলিফার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করে।

3. গণ আন্দোলন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি , খাদ্যাভাব , বেকারত্ব , সৈন্যবাহিনী থেকে ছাঁটাই , করভার বৃদ্ধি প্রভৃতি সামাজিক সমস্যাগুলি ব্যাধির মতো সাধারণ মানুষের নিত্যসঙ্গী হলে বামপন্থী সংগঠনগুলি ইংরেজ সরকারের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে । তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন সামাজিক সমস্যা নিয়ে কোনো প্রকার সচেতনতা দেখায়নি । পরিণামে ব্রিটিশ সরকারবিরোধী আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে এবং সমগ্র ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে । এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিই ব্রিটিশ সরকারকে নতুন আইন প্রণয়নে বাধ্য করেছিল ।

4. বিপ্লবী কাজকর্ম : এই সময় ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠে । সশস্ত্র বিপ্লবীরা বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে সরকারকে আতঙ্কিত ও ব্যতিব্যস্ত করে তোলে । সেই কারণেই ভারতীয়দের যাবতীয় বিক্ষোভ ও আন্দোলনকে দমন করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন প্রবর্তন করে ।

5. অগ্ৰীম সতর্কবার্তা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করা ভারতের পক্ষে বিন্দুমাত্র লাভজনক ছিল না । ইংল্যান্ডের উপনিবেশ হওয়ার দরুন একপ্রকার বাধ্য হয়েই ভারত বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করেছিল । তাই ব্রিটিশ সরকার অনুমান করেছিল যে , প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ভারতে এক অস্বাভাবিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে । এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন তাই যথাযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

6. দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের ব‍্যবহার : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে । কাজের আশায় ভারতীয়রা দক্ষিণ আফ্রিকা – সহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । কর্মস্থলে ব্রিটিশ সরকার এবং শ্বেতাঙ্গরা ভারতীয়দের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করত । দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য ব্রিটিশ ডোমিনিয়নে ভারতীয়দের উপর ব্রিটিশ সরকার ও শ্বেতাঙ্গদের এই অমানবিক আচরণ এই আইন প্রবর্তনের পটভূমি তৈরি করেছিল।

রাওলাট আইনের শর্ত :

ভারতের ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদ , গণ আন্দোলন , বিপ্লবী কার্যকলাপ প্রভৃতি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই রাওলাট আইনটি প্রণয়ন করা হয় এই আইনের শর্তগুলি ছিল-

1. সরকারবিরোধী সব ধরনের প্রচারকার্য দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।

2. সন্দেহভাজন যে – কোনো ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে এবং বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল তাদের কারারুদ্ধ করে রাখা বা নির্বাসন দেওয়া যাবে।

3. সরকার যে – কোনো ব্যক্তির বাড়ি বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি করতে পারবে।

4. অবশেষে আদালতে বিচারকগণ কোনো জুরির সহায়তা এবং কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই বিচার করতে পারবেন ।

5. এই আইনের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো উচ্চতর আদালতে আপিল মামলা দায়ের করা যাবে না ।

6. কোনো সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারবে না।

7. এই আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনীতি , শিক্ষা বা ধর্মসংক্রান্ত কোনো কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

8. এই আইনে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির মুক্তির জন্য অর্থ জমা দিতে হবে।

আরও পড়ুন : 

ক্রিপস মিশন কি ? এই মিশনের প্রস্তাব, ব‍্যর্থতার কারণ এবং ভারতে আসার প্রতিক্রিয়া

ঠান্ডা লড়াইয়ে কারণ ও বৈশিষ্ট্য

1946 সালের নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল

প‍্যালেস্টাইন সমস্যার কারণ 

1 thought on “রাওলাট আইন কি ? What is Rowlatt Act 1919 | রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য এবং শর্ত”

Leave a Comment