নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল | 1946 সালের নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল

নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল : আজকের আলোচনা নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে। নৌবিদ্রোহ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি বারবার এসে থাকে। সুতরাং আর দেরি না করে দেখে নাও 1946 সালের নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল গুলি।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল 1946 সালের 18 ফেব্রুয়ারি সংঘটিত ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ । ইতিমধ্যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন , আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রাম ইত্যাদি ঘটনার ফলে ব্রিটিশ সরকার দিশেহারা হয়ে পড়েছিল । 1946 খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহ যেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিল । 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে এই নৌবিদ্রোহই ছিল ব্রিটিশদের কাছে সবচেয়ে ত্রাসের কারণ । ড . সুমিত সরকার এই বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বীরোচিত বলে অভিহিত করেছেন।

Read More: Quora

নৌবিদ্রোহের কারণ

ভারতীয় নৌসেনাদের এই বিদ্রোহের পিছনে বেশ কতকগুলি কারণ ছিল সেগুলি নিম্নরূপ-

1. বর্ণবিভেদ : ভারতীয় নৌবাহিনীতে প্রবল বর্ণবৈষম্য ছিল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় নাবিকরা দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার যুদ্ধে গিয়ে দেখেন যে , কোনো কাজে নিযুক্ত ভারতীয় নাবিক যে পরিমাণ বেতন ও সুযোগসুবিধা পায় , সেই একই কাজে বা পদে নিযুক্ত থেকে ইংরেজ নাবিকরা ভারতীয়দের চেয়ে অনেক বেশি বেতন ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা পায় । ভারতীয় নাবিকরা এই বৈষম্যের প্রতিবাদ করে কখনও প্রতিকার পায়নি।

2. খারাপ ব‍্যবহার : ব্রিটিশ সরকার এবং ইংরেজ নাবিকরা ভারতীয় নাবিকদের প্রতি বিভিন্ন অন্যায় আচরণ করত । ইংরেজ অফিসার ও নাবিকরা ভারতীয় নাবিকদের অশ্লীল ও অভদ্র ভাষায় গালিগালাজ করত । শুধু ভারতীয় হওয়ার অপরাধে ভারতীয় সেনাদের এসব লাঞ্ছনা ভোগ করতে হত । ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার অনুরোধ করেও কোনো সুবিচার পায়নি।

3. নিম্নমানের খাবার সরবরাহ : সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় নৌ – সেনাদের অসন্তোষের অন্যতম কারণ ছিল তাদের নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ করা হত । ইংরেজ অফিসার ও কর্মচারীরা যথেষ্ট ভালো খাবার পেলেও সরকার ভারতীয় নাবিকদের অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার দিত । তীব্র প্রতিবাদেও এর কোনো সুরাহা না হওয়ায় তাদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল ।

4. বৈষম্যমূলক আচরণ : ভারতীয় নাবিকদের নিম্নমানের পুরোনো অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে হত বলে যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি প্রাণ যেত তাদেরই । ব্রিটিশ সরকারের এই বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ জানিয়েও ভারতীয় নৌ – সেনারা কোনো সুফল পায়নি । তাই ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে।

5. বিশ্বযুদ্ধের আচর : 1939 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্রচুর ভারতীয়কে নৌবাহিনীতে নিয়োগ করা হয় । কিন্তু যুদ্ধের পর অতিরিক্ত সেনার প্রয়োজন না থাকায় সরকার বহু সেনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে । এতে তারা বেকার হয়ে পড়ে । এর ফলে নৌবাহিনীতে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

6. বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা লাভ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় নৌ – সেনারা বিদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করে । বিদেশের পরিস্থিতির দ্বারা ভারতীয় নৌ – সেনারা প্রভাবিত হলে এদেশে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়।

7. আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনীর বিচার : সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রাম ভারতীয় নৌ – সেনাদের খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল । আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মত্যাগ এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য এই বাহিনীর সংগ্রাম ভারতের নৌ – সেনাদের নতুন দিশা দেখায় । পরাজিত আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের লালকেল্লায় বিচার শুরু হলে দেশের জনগণের সঙ্গে ভারতীয় নৌ – সেনারাও ক্ষোভে ফেটে পড়ে ।

8. ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিযুদ্ধ দমন : ব্রিটিশ সরকার তাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা উপনিবেশগুলির স্বাধীনতার আন্দোলনকে অবদমিত করতে ভারতীয় নৌ – সেনাদের ব্যবহার করে । ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিযুদ্ধকে স্তব্ধ করে দিতে ভারতীয় নৌ – সেনাদের ইন্দোনেশিয়াগামী জাহাজে পাঠাতে উদ্যত হলে ভারতীয় নৌ – সেনারা তার প্রতিবাদ করে।

নৌবিদ্রোহের ফলাফল : ( গুরুত্ব )

1946 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় নৌ – সেনাদের বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল । কিন্তু বিভিন্ন পণ্ডিত ভারতের তৎকালীন পরিস্থিতিতে সংঘটিত নৌবিদ্রোহের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন । ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্ত , হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় , সুমিত সরকার , গৌতম চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ 1946 খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহের উচ্চ প্রশংসা করেছেন । রজনীপাম দত্ত – এর মতে , “ নৌবিদ্রোহ ছিল ভারতের ইতিহাসে নবযুগের সূচনাকারী । ” নৌবিদ্রোহের ফলাফল গুলি হল

1. ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ঘোষণা : নৌবিদ্রোহ যে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের মৃত্যুঘণ্টা ধ্বনিত করেছিল তাতে সন্দেহ নেই । ভারতীয় সেনাদের উপর নির্ভর করে আর যে ভারত শাসন করা সম্ভব নয় , এ কথা ব্রিটিশ সরকার স্পষ্ট বুঝতে পারে । এককথায় , এই বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করে।

2. মন্ত্রী মিশনের আগমন : রজনীপাম দত্তের মতে , নৌবিদ্রোহের ফলে আতঙ্কিত ইংরেজ সরকার শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের সঙ্গে আলোচনা করতে মন্ত্রী মিশনকে ভারতে পাঠায় । 18 ফেব্রুয়ারি নৌবিদ্রোহ শুরু হয় এবং পরের দিন ভারতে মন্ত্রী মিশন পাঠানোর কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়।

3. ভারত ছাড়ার চিন্তা : কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন , নৌবিদ্রোহে ভারতীয় সেনা ও সাধারণ মানুষের রক্ত এক অভিন্ন আদর্শে একসঙ্গে মিশে যায় । ভারতে এরূপ আরও একটি বিদ্রোহ শুরু হলে তার পরিণাম যে কী ভয়ংকর হবে এবং তা দমন করা যে তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না , সেটা বুঝতে পেরে ব্রিটিশ সরকার শীঘ্রই ভারত ত্যাগের কথা ভাবতে শুরু করে।

4. হিন্দু – মুসলিম ঐক্য : নৌবিদ্রোহ ভারতে হিন্দু – মুসলিম ঐক্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিল । হিন্দু – মুসলিম নাবিক , সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ধারণাকে মজবুত করেছিল নৌবিদ্রোহ।

ড . সুমিত সরকারের মতানুসারে , এই বীরোচিত সংগ্রাম ভারত ইতিহাসে অনেকাংশে এক বিস্মৃত অধ্যায় হলেও আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল । গৌতম ভদ্র এই বিদ্রোহকে ‘ Almost Revolution ‘ বলেছেন । এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল , তবে এই ব্যর্থতা ছিল ‘ A political earthquake of devastating intensity ‘ , উৎপল দত্ত – এর কল্লোল নাটকে নৌবিদ্রোহের জীবন্ত চিত্র বর্ণিত হয়েছে । মার্কসবাদী লেখক রজনীপাম দত্ত ‘ Indian History ‘ গ্রন্থে বলেছেন , নৌ – নাবিকদের অভ্যুত্থান , সাধারণ মানুষদের এতে সমর্থন এবং বোম্বাইয়ের শ্রমিকশ্রেণির নায়কোচিত সিদ্ধান্ত ভারতে নবযুগের সংকেত দিয়েছিল এবং এটি ছিল ভারতীয় ইতিহাসের অনবদ‍্য চিহ্ন মাত্র।

আরও পড়ুন :

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা কি ? বৈশিষ্ট্য এবং ফলাফল

ঠান্ডা লড়াই কি ? ঠান্ডা লড়াইয়ের কারণ ও বৈশিষ্ট্য

সার্ক কি ? সার্কের উদ্দেশ্য, সাফল‍্য, সমস্যা

প্রশ্ন :

1. নৌবিদ্রোহ কত সালে হয় ?

উ: 1946 সালে 18 ফেব্রুয়ারি।

2. নৌবিদ্রোহ কোন জাহাজে প্রথম শুরু হয়েছিল ?

উ: তলোয়ার জাহাজে

3. কোন স্থানে প্রথম নৌবিদ্রোহ হয়েছিল ?

উ: বোম্বাই

4. 1946 সালের নৌবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কে ?

উ: এম এস খান

1 thought on “নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল | 1946 সালের নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল”

Leave a Comment