মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা কি ? মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা কি ? মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল

মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা কি ? What is Mountbatten Plan | মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল : আজকের পর্বটিতে আলোচনা করবো মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা কি ? মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। চলুক দেখে নেওয়া যাক।

মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা কি

স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় ভারতবাসীর তীব্র সংগ্রাম ব্রিটিশরাজকে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নের মীমাংসা করতে বাধ্য করে । হিন্দু – মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ভারতবর্ষ যখন আতঙ্কিত , তখন ভারতের এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে ব্রিটিশ সরকার দেশভাগের অনিবার্যতা স্বীকার করে নেয় । এই পট ভূমিকায় 1947 খ্রিস্টাব্দের 22 মার্চ ভারতের বড়োলাট হয়ে আসেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন । তিনি 24 মার্চ ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারত বিভাগের একটি পরিকল্পনা রচনা করেন এবং 3 জুন সেই পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলি ঘোষণা করেন । তাঁর প্রস্তাবিত ঘোষণা মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা ( Mountbatten Plan ) নামে পরিচিত।

মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা মূল বিষয় বা প্রস্তাবসমূহ :

ভারত সরকারের মুখ্য সাংবিধানিক উপদেষ্টা ভি পি মেনন মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনাটির খসড়া রচনা করেছিলেন এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে-

1. 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ‘ ভারত ’ ও ‘ পাকিস্তান ’ দুটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করবে ।

2. এই দুই রাষ্ট্রই স্বাধীনভাবে নিজের নিজের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়গুলি পরিচালনা করবে ।

3. দেশীয় রাজ্যগুলি ব্যতীত বোম্বাই , গুজরাট , দিল্লি , উত্তরপ্রদেশ , বিহার , উড়িষ্যা , পশ্চিম বাংলা , মাদ্রাজ , মধ্যপ্রদেশ , আজমির , কুর্গ ও মুসলিম অধ্যুষিত শ্রীহট্ট ছাড়া আসাম ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্গত হবে ।

4. পাকিস্তানের অন্তর্গত হবে সিন্ধু , বেলুচিস্তান , উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ , পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ববাংলা ।

5. পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করা হবে এবং এই দুই প্রদেশের কোন কোন্ অঞ্চল কোন্ ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবে তা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠন করা হবে।

6. উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আসামের শ্রীহট্ট জেলা কোন্ ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবে তা গণভোট দ্বারা স্থির হবে ; যদিও শেষ পর্যন্ত শ্রীহট্ট ভারতের অধীনে থাকেনি।

7. দেশীয় রাজ্যগুলির রাজাদের ভারত বা পাকিস্তান যে – কোনো ডোমিনিয়নে যোগদানের অধিকার দেওয়া হয় , ইচ্ছা করলে তারা স্বাধীন থাকতেও পারবে— এই নির্দেশও দেওয়া হয়।

8. ভারত ও পাকিস্তান ডোমিনিয়নকে আপাতত ইংল্যান্ডের রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথগ্রহণ করতে বলা হয় ।

9. উভয় ডোমিনিয়ন নিজস্ব গণপরিষদ বা আইনসভা গঠন করে নিজ ডোমিনিয়নের সংবিধান রচনা করবে বলে স্থির হয়।

10. 1947 সালের 15 আগস্ট থেকে দেশীয় রাজ্যগুলির উপর ব্রিটেনের সার্বভৌম অধিকার বিলুপ্ত হবে বলে স্থির করা হয়।

মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা ফলাফল :

ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি  মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা মেনে নিলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 1947 খ্রিস্টাব্দের 4 জুলাই এক বিশেষ অধিবেশনে ভারতের স্বাধীনতা আইন পাস করে এবং 18 জুলাই এই আইনে রাজকীয় সিলমোহর পড়ে । এই আইন অনুসারে এই পরিকল্পনার ফলাফল হল-

1. 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে । এই রাষ্ট্র দুটির জন্য দুজন গভর্নর জেনারেল নির্ধারিত হবেন ও স্বতন্ত্র আইনসভা গঠিত হবে।

2. নতুন সংবিধান রচনা না হওয়া পর্যন্ত উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রয়োজনানুযায়ী পরিবর্তন – সহ 1935 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন বলবৎ থাকবে।

3. দেশীয় রাজ্যগুলি যে – কোনো রাষ্ট্রে যোগদানের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে ।

গান্ধিজি এই সিদ্ধান্তে প্রচন্ড মানসিক আঘাত পান । কংগ্রেস নেতারাও জানতেন না যে , ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত অধিকাংশ ভারতীয়ের কাছেই অপ্রত্যাশিত আঘাত হিসেবে নেমে আসবে । তাই দেশবাসীর মানসিক প্রস্তুতির জন্য জুন মাসে নেতৃবৃন্দ বেতার ভাষণে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলির সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন । নেহরু বলেন যে , “ আমি এই প্রস্তাব আনন্দ মনে উত্থাপিত করছি না , যদিও আমার কোনো সন্দেহ নেই যে এটিই শ্রেষ্ঠ বিকল্প । ” বলাবাহুল্য , জিন্নাহ বিজয়ীর আবেগে এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানান । এস আর মেহরোত্র মনে করেন , “ ভারত বিভাগে সম্মত হয়ে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কম ক্ষতিকারক বিকল্পটি গ্রহণ করেছিলেন , তা না হলে ভারত গৃহযুদ্ধ , নৈরাজ্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হত। ”

ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট খণ্ডিত ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে । সৃষ্টি হয় দুটি রাষ্ট্র— ভারত ও পাকিস্তান । বিভক্ত বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমানা স্থির করার জন্য র‍্যাডক্লিফ – এর সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয় । কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ থেকে দুজন করে প্রতিনিধি সীমান্ত নির্ধারণ কমিটির সদস্য হন । নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুটি অংশ হয় – পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান । পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে পূর্ববাংলা ও আসামের শ্রীহট্ট জেলা এবং সিন্ধু , বেলুচিস্তান , পশ্চিম পাঞ্জাব নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তান । গণভোটের পর উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানে যোগ দেয় । 15 আগস্টের মধ্যে জম্মু – কাশ্মীর , জুনাগড় ও হায়দরাবাদ ছাড়া ভারতের অন্তর্গত সব দেশীয় রাজ্য ভারত রাষ্ট্রে যোগ দেয়।

স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিজে । প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন জওহরলাল নেহরু । অন্যদিকে পাকিস্তানের গভর্নর – জেনারেল ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ এবং প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকৎ আলি খান । দুটি রাষ্ট্রের গণপরিষদ বা সংবিধান সভার উপর নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পিত হয় । 14-15 আগস্ট মধ্যরাত্রিতে গণপরিষদে জওহরলাল নেহরু আবেগদীপ্ত ভাষণে বলে উঠলেন , “ মধ্যরাত্রির ঘণ্টা যখন বাজবে , বিশ্ব যখন গভীর নিদ্রামগ্ন , ভারত তখন জীবন ও স্বাধীনতার আনন্দে জেগে উঠবে । ” [ At the stroke of the midnight hour , when the world sleeps , India will awake to life and freedom ] । নেহরু কথিত ‘ স্বাধীনতার আনন্দ ’ নিখাদ ছিল না ; তার সঙ্গে মিশেছিল দেশবিভাগের বিষাদ ও যন্ত্রণা ।

মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য :

এই পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য গুলি হল –

1. গান্ধিজির প্রতিক্রিয়া : প্রথমদিকে গান্ধিজি , মৌলানা আজাদ , আব্দুল গফ্ফর খান প্রমুখ কংগ্রেসী নেতা  মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা ও দেশবিভাগের তীব্র বিরোধী ছিলেন । গান্ধিজি বলেন , “ কেবলমাত্র আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে ভারত বিভাগ হতে পারে । ” অবশ্য ক্রমে গান্ধিজি বুঝতে পারেন যে , তৎকালীন পরিস্থিতি অনুযায়ী দেশবিভাগ অনিবার্য । দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত দেশভাগের প্রস্তাব মেনে নেন এবং ১৪ জুন ওয়ার্কিং কমিটিতে দেশভাগের পক্ষে সওয়াল করেন।

2. আজাদের প্রতিক্রিয়া : মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতে , “ দেশভাগ হল এক দৈব দুর্বিপাক । ” তাঁর মতে , ভারতভাগ হল কংগ্রেসের রাজনৈতিক পরাজয়ের শামিল ।

3. প্যাটেল ও রাজেন্দ্রপ্রসাদের বক্তব্যে : বল্লভভাই প্যাটেল মনে করেছিলেন যে , ভারত ভাগ কংগ্রেসের পরাজয় বা নতিস্বীকার নয় , তৎকালীন পরিস্থিতিতে দেশবিভাগই ছিল সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ । তাঁর মতে , “ There is no alternative to divide ” ড . রাজেন্দ্র প্রসাদের মতে , গৃহযুদ্ধের চেয়ে দেশভাগ ভালো।

4. আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতাদর্শ : আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনেকেই ভারত বিভাজনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সমর্থনকে ‘ বাস্তবসম্মত ’ বলে মনে করেন । ড . এস আর মেহরোত্র বলেন যে , ভারত বিভাগে সম্মত হয়ে কংগ্রেস অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকারক বিকল্পটি গ্রহণ করেছিল । অন্যথায় গৃহযুদ্ধ , নৈরাজ্য ও চরমতম বিশৃঙ্খলা ভারতভূমিকে গ্রাস করত।

5. জিন্নাহর প্রতিক্রিয়া : পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও কয়েদ – এ – আজম জিন্নাহ সম্পূর্ণ খুশি হতে পারেননি । কারণ তিনি সমগ্র বাংলা ও পাঞ্জাবকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন । তাঁর সেই সুপ্ত বাসনা অধরাই থেকে যায়।

ভারত বিভাজন : কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব মেনে নেওয়ায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অতি দ্রুত ভারতের স্বাধীনতা আইন পাস হয় । 1947 খ্রিস্টাব্দের 4 আগস্ট এই আইন অনুসারে 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয় । বিভক্ত বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমানা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে সিরিল র‍্যাডক্লিফ ( Cyril Radcliffe ) – এর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয় এবং ভারত ও পাকিস্তানে দুটি পৃথক গণপরিষদ গঠন করা হয়।

আরও পড়ুন :

ঠান্ডা লড়াই কি ? ঠান্ডা লড়াই এর কারণ ও বৈশিষ্ট্য

সার্ক কি ? সার্কের উদ্দেশ্যে, সাফ‍ল‍্য, বৈশিষ্ট্য

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণ, বৈশিষ্ট্য, ফলাফল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

3 thoughts on “মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনা কি ? মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল”

Leave a Comment