সার্ক কি ? What is SAARC | সার্কের উদ্দেশ্য, সমস্যা ও সাফল্য : এখানে সার্ক কি এবং সার্কের উদ্দেশ্য, সমস্যা ও সাফল্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সার্ক কি মূলত সেটি জানতে হলে এই পোষ্টটি অবশ্যই পড়তে হবে। What is SAARC বা সার্ক কি নিম্নে আলোচনা করা হয়েছে। চলুন দেখে নিই সংক্ষেপে সার্ক কি।
🔸সার্ক কি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক , সামরিক ও বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে যে সংগঠন গড়ে ওঠে , তার নাম হল সার্ক ( SAARC ) বা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক সংগঠন ( South Asian Association for Regional Cooperation )। এই সংগঠনের মূল 8 টি সদস্যরাষ্ট্র হল- 1.ভারত ,2. বাংলাদেশ , 3.নেপাল , 4.ভুটান , 5.শ্রীলঙ্কা , 6.পাকিস্তান 7.মালদ্বীপ ও 8. আফগানিস্তান। ঢাকার রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমানের সক্রিয় উদ্যোগ , উৎসাহ ও সভাপতিত্বে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্কের প্রতিষ্ঠা হয়। সার্ক প্রতিষ্ঠার পিছনে নিহিত মূল লক্ষ্য ও অনুপ্রেরণা ছিল -সার্ক অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে শান্তি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি দীর্ঘস্থায়ী ও সুনিশ্চিত করা।
🔸সার্কের উদ্দেশ্য :
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী রাজীব গান্ধি বলেছিলেন যে , সার্ক দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে তার সদস্য রাষ্ট্রগুলির আত্মনির্ভরতার সমস্যার সমাধান , দারিদ্র্য দূরীকরণ , সাক্ষরতার প্রসার , অপুষ্টি ও রোগ দূরীকরণের সঙ্গে যুক্ত । সার্ক বা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে । এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি নিম্নরূপ-
1. উন্নয়ন : দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি , সামাজিক অগ্রগতি এবং সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো।
2. আত্মনির্ভরতা : সার্কের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষা এবং যৌথ আত্মনির্ভরতার শক্তি বৃদ্ধি করা।
3. উৎসাহ প্রদান : অর্থনৈতিক , বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় সক্রিয় সহযোগিতার বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে উৎসাহিত করা ।
4.যোগাযোগ আদানপ্রদান বৃদ্ধি : সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে তথ্যের এবং সেসব দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা।
5. জনকল্যাণ : দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির জনগণের কল্যাণসাধন এবং তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানো ।
6 সহযোগিতা : সামাজিক , সাংস্কৃতিক , অর্থনৈতিক , কারিগরি , বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা । অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির সঙ্গেও এই সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
7. উন্নয়ন : দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির দ্বারা সার্কের সদস্যগুলির অর্থনৈতিক বিকাশ , সামাজিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক উন্নতি ঘটানো ।
8. বোঝাপড়া : সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস , বোঝাপড়া ও সংবেদনশীলতার পরিবেশ তৈরি করা।
9. হস্তক্ষেপ না করা : সদস্য রাষ্ট্রগুলির ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা ও অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।
10. নিরাপত্তা বিধান : দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ করা।
11. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান : সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা ।
🔸সার্কের সমস্যা গুলি হল :
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সার্কের কার্যকলাপ এতদিন নানা ঘাত – প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়েও বিশ্বরাজনীতিতে মোটামুটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে । বর্তমানে সার্কের বেশ কিছু বাস্তবোচিত পদক্ষেপ তাকে সাফল্য এনে দিয়েছে । তবে সার্কের প্রথমদিকের জড়তাসম্পন্ন কার্যকলাপ তার বিশেষ কয়েকটি সমস্যা ও দুর্বলতাকে প্রকট করে তোলে।
1. সহযোগিতার অভাব : সার্কের 8 টি সদস্যরাষ্ট্র পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এই সংগঠন গড়ে তুললেও প্রথমদিকে এদের মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতার মনোভাব দেখা যায়নি । যে যে রাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক ছিল , তাদের সেই দ্বিপাক্ষিক ঝামেলার জের সার্কের কার্যকলাপের মধ্যেও পড়েছিল ।
2. ভারতের ক্ষমতা সম্পর্কে ভীতি : সার্কের অন্তর্ভুক্ত সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র ছিল ভারত , তার বিশালতা , তার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার ক্ষমতা , জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রভাব — সবকিছু মিলিয়ে ভারতকে সম্ভ্রমের চোখে দেখত অন্যান্য সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলি । ভারত সার্কের ভিতর নিজের ক্ষমতা জাহির না করলেও অন্যান্য সদস্যরা তার থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখায় সার্কের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের উন্নতি ঘটেনি।
3. দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনমন : ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা , নেপাল , বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনমন সার্কের সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল । শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহ , বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগীরথীর জলবণ্টন সমস্যা , পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর সমস্যা প্রভৃতি সার্কের কার্যকলাপকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
4. আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব : দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত ছোটো ছোটো দেশগুলির জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এত প্রখর ও দৃঢ় যে , সার্কের ন্যায় একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তুললেও এদের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ এখনও হয়নি ।
5. বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনীতি : সার্কের আশপাশের অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্র , যেমন — চিন ও জাপান বা দূরবর্তী বিদেশি রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক কাজকর্ম সার্কের সাফল্যে বাধাদান করে । ক্রমাগত ভারতের বিরুদ্ধাচরণে পাকিস্তানকে মার্কিনি মদত , চিনের ভারত ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা প্রভৃতি সার্কের প্রকৃত দায়িত্ব থেকে তাকে বিমুখ করেছিল।
6. দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা : সার্কের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির অন্যতম বড়ো সমস্যা ছিল দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা । সার্কের অধিকাংশ রাষ্ট্রের জনগণই দরিদ্র ; সার্ক প্রথম থেকেই এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে এসেছে । আর নিরক্ষরতা কর্মসূচি এখনও সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করা যায়নি।
7. শিশুশ্রম বন্ধ ও নারীদের সম্মান রক্ষা : সার্কভুক্ত দেশগুলির অন্যতম সমস্যা হল শিশুশ্রম । বিশেষত আমাদের ভারতেই শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৩৪ মিলিয়ন । আবার এই দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক অত্যন্ত কম হওয়ায় এখানে শ্রমিক শোষণের মাত্রা সর্বাধিক । বিদেশে পতিতাবৃত্তির জন্য পাচার হওয়া মেয়েদের মধ্যে এশীয়দের সংখ্যাই সর্বাধিক।
8. নতুন প্রযুক্তিবিদ্যার অভাব : দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলি মূলত কৃষিনির্ভর । কিন্তু আধুনিক কৃষি – প্রযুক্তি এবং শিল্পক্ষেত্রে প্রযুক্তির অভাব সার্ককে স্বনির্ভর হতে বাধা দিয়েছিল । এ ছাড়া সার্ক তার বাণিজ্যিক মানসিকতার অভাবেও নিজ সংগঠনকে দুর্বল করে তুলেছিল।
🔸সার্কের সাফল্য গুলি হল :
সার্কের বহুবিধ জটিলতা ও সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে সার্কের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের নজির পাওয়া যায় । তাই সার্কের সাফল্য একেবারে উপেক্ষা করা যায় না-
1. SAPTA স্বাক্ষর : প্রাথমিক দুর্বলতা কাটিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সার্ক তার বাস্তবজ্ঞানের প্রথম প্রমাণ দিয়েছে SAPTA অর্থাৎ South Asian Preferential Trade Agreement স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে । ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর নতুন দিল্লিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সার্কভুক্ত দেশগুলি পরস্পরকে বহুবিধ বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার করে । এই সকল সুবিধার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— রফতানি শুল্ক তুলে দেওয়া , অবাধ বাণিজ্য প্রবর্তন , নির্দিষ্ট কিছু দ্রব্যে শুল্ক ছাড় , অভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা প্রভৃতি।
2. দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন : পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বিশ্বাস দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির মধ্যে বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে সার্কভুক্ত দেশগুলির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে । ভারত – পাক যুদ্ধের সাময়িক ইতি , দুই দেশের পরমাণু বোমার পরীক্ষানিরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ের সমাধান , শ্রীলঙ্কার তামিল সমস্যার সমাধান প্রভৃতি ঘটনাবলি এই দেশগুলির সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছে।
3. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব বৃদ্ধি : বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সার্কের গুরুত্ব ও সম্মান যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে । বিশেষত সার্কের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিয়মিত । শিশুকল্যাণ বিষয়ে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনিসেফ চুক্তি ( UNICEF ) , ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পরিবেশ বিষয়ে UNDCP– এর সঙ্গে চুক্তি , ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দেই মাদক দ্রব্যের নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে UNDCP– এর চুক্তি , এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি প্রভৃতি ছিল এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ।
4. সমমনস্ক অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে চুক্তি : সার্ক তার উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সমমনস্ক অন্যান্য সংগঠন , যেমন— ASEAN , ECO , EU এর সঙ্গেও চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল ।
5. সার্কের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা : খেলাধুলো ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলি বিশেষ সাফল্য পেয়েছে । বিশেষত সার্ক গেমস যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বর্তমানে । বিশ্বমানের উন্নয়ন , সাংস্কৃতিক সফর , পর্যটন ক্ষেত্র প্রভৃতির মাধ্যমে সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলিকে একসূত্রে বেঁধে রাখার চেষ্টা চলছে । তাই পরিশেষে বলা যায় , সার্ক তার প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে নিজস্ব সমস্যা দূরীকরণে যেমন এগিয়ে এসেছিল ; তেমনি বাণিজ্য , রাজনীতি , আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিল । বর্তমানেও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত।
আরও পড়ুন :
শিল্পবিপ্লব কাকে বলে ? কারণ ,ফলাফল
স্মৃতিকথা কাকে বলে ? স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব
কিংবদন্তি কাকে বলে ? বৈশিষ্ট্য
জাদুঘর কাকে বলে ? গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্নঃ
1. SAARC এর পূর্ণরূপ কি ?
উ: South Asian Association for Regional Cooperation
2.সার্কের প্রতিষ্ঠতা কে ?
উ: ঢাকার রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমানের সক্রিয় উদ্যোগ , উৎসাহ ও সভাপতিত্বে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্কের প্রতিষ্ঠা হয়।
3.সার্ক কয়টি দেশ নিয়ে গঠিত ?
উ: 8 টি
4. সার্ক এর কাজ কি ?
উ: সার্ক দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে তার সদস্য রাষ্ট্রগুলির আত্মনির্ভরতার সমস্যার সমাধান, দারিদ্র দূরীকরণ, সাক্ষলতার প্রসার, অপুষ্টি ও রোগ দূরীকরণ প্রতৃতি হল সার্কের কাজ।
2 thoughts on “সার্ক কি ? What is SAARC | সার্কের উদ্দেশ্য, সমস্যা ও সাফল্য”