সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি কি ? What is Communal Award | সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির উদ্দেশ্য

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি কি

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি কি ? What is Communal Award | সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির উদ্দেশ্য : এই পর্বটিতে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। এটি ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন।

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি :

ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম হাতিয়ার ও বৈশিষ্ট্য ছিল বিভেদ ও শাসননীতি ( Divide & Rule Policy ) । আর সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা (Communal Award) নীতি ছিল তারই ফলশ্রুতি । জাতপাতের ভিত্তিতে ভারতের জনগোষ্ঠীকে বিভিন্নভাগে বিভক্ত করে ইংরেজ শাসনকে সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী করার এটা একটি কৌশলী পদক্ষেপ । ভারতীয় রাজনীতিতে এর মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঘটে।

Read More: Quora

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি :

ভারতে বসবাসকারী হিন্দুদের সঙ্গে মুসলিম , শিখ , অনুন্নত হিন্দু , ভারতীয় খ্রিস্টান , হরিজন প্রভৃতি সম্প্রদায়ের বিভেদ সৃষ্টির দ্বারা ঐক্যে ফাটল ধরানো এবং ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে 1932 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ( Ramse MacDonald ) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আইনসভায় পৃথক নির্বাচনের যে অধিকার প্রদানের কথা ঘোষণা করেন , সেটি ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ( Communal Award ) নীতি নামে পরিচিত।

সাম্প্রদায়িক কথাটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে যথা-

1. সাম্প্রদায়িকরা মনে করে , তারা যে ধর্মের অনুরাগী সেই ধর্মের সকল লোকের রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক স্বার্থ এক এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের থেকে তাদের স্বার্থ পৃথক।

2. এই মতের অনুসরণকারী প্রচার করেন যে , বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী । সুতরাং , হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থ কখনোই এক হতে পারে না।

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির প্রেক্ষাপট ও মূল নীতি :

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সরকারি উদ্যোগে ভারতীয় রাজনীতিতে ভেদনীতি প্রয়োগ করা হয় । সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ছিল ব্রিটিশ সরকারের সেই উদ্যোগের ফলশ্রুতি।

প্রেক্ষাপট : ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলের ও সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতি ঘটে কিন্তু সেই সকল ক্ষেত্রে অন্য অঞ্চলগুলি পিছিয়ে কারণে যে ব্যবধান তৈরি হয় , তার ফলে সাম্প্রদায়িক ভাবধারার উদ্ভব ঘটে । সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির উদ্ভবের কারণগুলি নীচে আলোচনা করা হল –

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির উদ্ভবের কারণ :

1. বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ সৃষ্টি হয় । অপরদিকে সিমলা দৌত্যের মাধ্যমে মুসলিম প্রতিনিধিদের বড়োলাট লর্ড মিন্টো সহানুভূতি ও যথাযোগ্য সহযোগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন । সেই সূত্র ধরেই 1906 খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হয় । 1909 খ্রিস্টাব্দে মর্লে – মিন্টো শাসনসংস্কার আইনে মুসলিমদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দান করা হয় এবং পরবর্তীকালে 1919 খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু – চেমসফোর্ড সংস্কার আইনেও তা বজায় রাখা হয় । এই সূত্র ধরেই গঠিত হয় সাইমন কমিশন । কমিশন ভারতের নানান জায়গার স্থানীয় প্রাদেশিক পরিষদের গঠন ও কার্যকারিতা সংস্কারের সুপারিশ করে । এই সুপারিশের ভিত্তিতে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক আহূত হয়।

ভারতে আইন অমান্য আন্দোলন চালানোর জন‍্য জাতীয় কংগ্রেস গোলটেবিল বৈঠকের প্রথম অধিবেশনে যোগ দেয়নি ( 12 নভেম্বর , 1930 খ্রি . ) । গান্ধি – আরউইন চুক্তির ( Gandhi Irwin Pact , 5 মার্চ , 1931 খ্রি . ) শর্তানুযায়ী গান্ধিজি লন্ডনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকের দ্বিতীয় অধিবেশনে যোগ দেন ( 7 সেপ্টেম্বর , 1932 খ্রি . ) । ইংল্যান্ডের ও ভারতের বিভিন্ন প্রথম শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা এই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন । তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন— মহম্মদ আলি জিন্নাহ , বি আর আম্বেদকর , সরোজিনী নাইডু প্রমুখ ।

3. দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের এই অধিবেশনে ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ব্রিটিশ সরকার সক্রিয় উদ্যোগ নেয় । ভারতীয় নেতারা প্রত্যেকে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থ সুরক্ষিত করার দাবি তোলেন । উপস্থিত মুসলিম নেতৃবৃন্দ , যথা- মহম্মদ আলি জিন্নাহ , আগা খান , মহম্মদ শফি , মহম্মদ আলি , ফজলুল হক দাবি জানান যে , মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবি সুরক্ষিত না হলে কোনো সংবিধানই তাদের পক্ষে মানা সম্ভবপর নয়।

কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে গান্ধিজি এই অযৌক্তিক দাবিকে অগ্রাহ্য করে নিজের দাবিকে তুলে ধরেন । মতভেদ তীব্র হয়ে উঠলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ঘোষণা করেন , ‘ ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় যদি নিজেরা গ্রহণযোগ্য সমাধান সূত্র তৈরি করতে না পারে তাহলে ব্রিটিশ সরকার নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে বাধ্য হবে । ‘ তাই বলা হয় , লন্ডনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় গোলটেবিল বেঠকের এই অধিবেশনটিই ছিল সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির সূতিকাগার।

4. আদমশুমারি কমিশনার হিসেবে রিজলি সমস্ত জাতিকে নথিভুক্ত করে তাদের সামাজিক স্তর নির্দিষ্ট করতে উদ্যোগী হন । ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে মহীশূর ও কোলাপুর রাজ্যের শাসকেরা জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ শুরু করে । সরকারও জাতিগত স্তরবিন্যাসের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল । এর দ্বারা অব্রাহ্মণদের চাকরি লাভের ক্ষেত্রটি ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে । নিকোলাস ডার্কস ( Nicholas Dirks ) এই জাতিভিত্তিক বিন্যাসের বিষয়টিকে ‘ Indian colonial form of civil society ‘ বলে অভিহিত করেছেন ।

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির উদ্দেশ্য :

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড 1932 খ্রিস্টাব্দের 16 আগস্ট সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণা করেন । এই নীতির দ্বারা মুসলিম , শিখ , বৌদ্ধ , অ্যাংলো – ইন্ডিয়ান , ভারতীয় খ্রিস্টান , ইউরোপীয় সম্প্রদায় প্রভৃতি সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয় । অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়কে বর্ণ হিন্দু ও অনগ্রসর হিন্দু – এই দুই ভাগে বিভক্ত করে তাদের পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা উদ্দেশ্য গুলি হল

1. স্বার্থ বজায় রাখা : সাম্প্রদায়িক মতবাদে বিশ্বাসীদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থ অটুট রাখা । পৃথক নির্বাচন নীতি অনুসরণ করে এই বাঁটোয়ারাতে মুসলমান , শিখ , ভারতীয় খ্রিস্টান , অ্যাংলো – ইন্ডিয়ান ও নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত হয়।

2. প্রাদেশিক পরিষদ : বলা হয় , এই বাঁটোয়ারা কেবলমাত্র প্রাদেশিক পরিষদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

3. পৃথক নির্বাচনি ব্যবস্থা ও সবার ভোটাধিকার : শ্রমিক , বণিক , শিল্পপতি , জমিদার , বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নির্দিষ্ট আসন ও পৃথক নির্বাচনি এলাকা দান করা হয় । অন্যদিকে সাধারণ নির্বাচনি এলাকায় সকলের ভোটাধিকার নির্দিষ্ট হয়।

4. দলিত হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটাধিকার : হরিজন বা তপশিলি হিন্দুরা ‘ সংখ্যালঘু ’ বলে ঘোষিত হয় এবং তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত হয় । পৃথক নির্বাচন ও সাধারণ নির্বাচনি এলাকার জন্য ততাদের 2 টি ভোটাধিকার দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন : 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

ক্রিপস মিশন কি ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব, ব‍্যর্থতার কারণ এবং ভারতে আসার প্রতিক্রিয়া 

প‍্যালেস্টাইন সমস্যার কারণ 

নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল 

মাউন্টব‍্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল

Leave a Comment