লোককথা কাকে বলে ? এবং লোককথার বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও শ্রেনিবিভাগ | What is Folklore And Characteristics, Importance, Classification

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

লোককথা কাকে বলে ? এবং লোককথার বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও শ্রেনিবিভাগ

লোককথা কাকে বলে ? এবং লোককথার বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও শ্রেনিবিভাগ :(What is Folklore And Characteristics, Importance, Classification) প্রতিটি সংস্কৃতির একটি নিজস্ব লোককথা রয়েছে। কিন্তু লোককথা ঠিক কি এবং তোমরা কিভাবে লক্ষ্য কথা সনাক্ত করবে এবং লোককথার বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে জানতে পড়তে থাকুন।

লোককথা দুটি শব্দের মিশ্রণে গঠিত ‘লোক’ যার অর্থ আঞ্চলিক মানুষ এবং ‘কথা’ যার অর্থ গল্প। তাই লোককথা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোকেদের গল্পকে প্রতিফলিত করে। তাহলে দেখে নেওয়া যাক লোককথা কাকে বলে

লোককথা কাকে বলে

লোককথা হল একধরনের কাল্পনিক গল্পকথা যেগুলি অতীত বা ঐতিহাসিক ঘটনার অনুকরণে গড়ে ওঠে। লোককথায় ঐতিহ্যবাহী লৌকিক সাহিত্যের প্রতিফলন ঘটে যার দ্বারা প্রাকৃতিক বা আধ্যাত্মিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা করা হয়। অতীত থেকেই লোক মুখে বংশপরম্পরায় লোককথাগুলি প্রচারিত হয়ে আসছে । অনুমান করা হয় সভ্যতার ইতিহাসে গোষ্ঠী জীবন শুরুর পরই লোকসমাজে লোককথার সৃষ্টি হয়েছে। কার্ল টমলিনসন ও ক্যারল লিঞ – ব্রাউন – এর মতে , “ মানুষের জীবন ও কল্পনার সংমিশ্রণে যেসব গল্পগাথা গড়ে উঠেছে ” সেগুলি হল লোককথা।

লোককথার বৈশিষ্ট্য

লোককথার বৈশিষ্ট্যগুলি নিচে আলোচনা করা হল-

1. লোক ঐতিহ্য : লোককথার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর ঐতিহ্য । বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক – ঐতিহ্যগুলি এতে স্থান পায়।’ আরব্য রজনী ‘ , ‘ ঈশপের নীতি কথা’, ‘ কথাসরিৎ সাগর’, ‘ বৃহৎকথামঞ্জুরী’, ‘ পঞ্চতন্ত্র’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘লুসিয়াস অ্যাপুলেইয়াসের লোককথা সংগ্রহ’, ‘জাঁ দ্য ফঁতেন – এর নীতিকথা ‘ প্রভৃতি লোককথার উদাহরণ

2 ঘটনার প্রাচুর্য : লোককথাগুলিতে ঘটনা বা বিষয়বস্তুর প্রাধান্য লক্ষ‍্যনীয় । ঘটনা বিন্যাসে দুধরনের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় , একটি হল ঘটনার সূচনা , সমস্যা , চরম মুহূর্ত , সংকট থেকে উত্তরণ এবং সবশেষে মিলনান্তক পরিণতি আর দ্বিতীয়টি হল কাহিনির মূল চরিত্রের গৃহত্যাগ , বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন এবং সবশেষে নিজের এলাকায় প্রত্যাবর্তন । লোককথাগুলিতে এই দুই ধরনের বিষয়বস্তুর প্রাধান্য দেখা যায়।

3.মানবিক আলোচনা : লোককথাগুলির কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকে মানুষ। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনকার জীবনকাহিনিই লোককথায় আলোচিত হয়। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাগুলি এতে স্থান পায় । মানবিক কর্মকাণ্ড ঘিরেই লোককথার অগ্রগতি ঘটে । অনেক সময় রূপকধর্মিতার আশ্রয় নেওয়া হলেও তার আড়ালে থাকে মানব চরিত্র।

4. শ্রুতিনির্ভর : লোককথা হল মৌখিক ঐতিহ্যভিত্তিক সাহিত্য বা শ্রুতি সাহিত্য । নিরক্ষর ও শিক্ষিত উভয় শ্রেণির মানুষের মুখে মুখে লোককথাগুলি এক পুরুষ থেকে পরের পুরুষ পর্যন্ত প্রচারিত হয় । এক অঞ্চলের লোককথা লোকমুখে অন্য অঞ্চলে প্রচারিত হয়।

5 .অতি কাল্পনিক : লোককথার কাহিনিগুলি প্রকৃতিগত বিচারে অতি কাল্পনিক। লোককথাগুলিতে যে রূপকথা , পরিকথা , পশুকথা , পুরাণ বা কিংবদন্তি স্থান পায় সেসবের চরিত্রগুলি বাস্তবধর্মী নয় , কল্পনাধর্মী । লোককথার রচয়িতাগণ কল্পনার জগৎ থেকে বিভিন্ন চরিত্র তুলে ধরেন । যেমন – ডাইনি, দৈত্য, পরি, ভূতপ্রেত প্রভৃতি।

6. রূপকধর্মী বৈশিষ্ট্য : লোককথার রাজা – রানি – রাজপুত্র রাজকন্যা -রাক্ষস – দৈত্য – ডাইনি – জাদুমন্ত্র -অলৌকিকতা
ইত্যাদির বহিঃসৌধের অন্তরালে সাধারণ মানুষের জীবনের আশা – আকাঙ্ক্ষা , চাওয়া – পাওয়া , কামনা – বাসনাগুলি লুকিয়ে থাকে । অনেক সময় রূপকধর্মিতা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন পশুপাখি , কীট – পতঙ্গের মধ্যে মানুষের মতো ব্যক্তিত্ব আরোপ করা হয় । যারা মানুষের মতো করে কথা বলে এবং মানুষের মতো করেই নিজেদের চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটায়।

7. সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা : বিশ্বসাহিত্যে লোককথার সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অসীম । একদেশের লোককথা সেইদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে । অর্থাৎ লোককথা কোনো ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না , তা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

লোককথার গুরুত্ব :

লোককথার কিছু গুরুত্ব রয়েছে যেগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-

1. সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় : বিভিন্ন দেশের নির্দিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লোককথাগুলি গড়ে ওঠে । তাই লোককথাগুলি হয়ে ওঠে সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক ঐতিহ্যের অনবদ্য পরিচায়ক। ধর্মবিশ্বাস , সংস্কার , খাদ্যাভ্যাস , বেশভূষা , সমাজরীতি – সহ সমাজ – সংস্কৃতির সম্যক পরিচয়দানে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে থাকে লোককথা।

2. অতীত ইতিহাসের ধারণা : বহু যুগ আগের কোনো জনগোষ্ঠীর বিস্তৃত ইতিহাসের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সহায়ক হিসেবে কাজ করে লোককথা। তাই লোককথাকে বলা হয় এক জীবন্ত ও অবিনশ্বর জীবাশ্ম । নৃতত্ত্ববিদদের ধারণায় আজ লোকসাধারণের মধ্যে যে সমস্ত বিশ্বাস , সংস্কার , প্রথা প্রভৃতির প্রচলন রয়েছে , সেগুলির অধিকাংশেরই হদিস মেলে লোককথায়।

3. বিনোদন ও শিক্ষাদান : যুগের পর যুগ ধরে লোককথার কাহিনি পাঠ করে পাঠককুল আনন্দ লাভ করে আসছে। নানা ধরনের অতিমানবিক কাহিনিগুলি পাঠকের মনোরঞ্জন করার পাশাপাশি লোককাহিনিগুলি পরোক্ষভাবে মানুষকে শিক্ষা দান করে । লোককথাগুলির সমাপ্তিতে থাকে নানা ধরনের নীতিবাক্য। তাই বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন লোককথার উপযোগিতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন , “ যদি তোমার সন্তানকে বুদ্ধিমান করে তুলতে চাও তবে তাদের লোককথার গল্প পড়তে দাও । যদি তাদের আরও বুদ্ধিমান করে তুলতে চাও তবে তাদের আরও বেশি লোককথার গল্প পড়তে দাও। ”

লোককথার শ্রেণিবিভাগ

লোককথাকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয় যাথা – 1.রূপকথা, 2. পরিকথা এবং 3. পশুকথা।

1 রূপকথা :

i. আত্মপ্রকাশ : উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রূপকথার মধ্যে দিয়েই লোকসাহিত্যের লিখিত রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে । ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে গ্রিম ভাইয়েরা রূপকথার প্রথম লিখিত সংকলন (প্রথম খণ্ড) প্রকাশ করে রূপকথার পরিচয় ঘটায়।

ii. মর্মার্থ : জার্মান ভাষার ‘ মারচেন ‘ কিংবা সুইডিশ ভাষার ‘ সাগা ’ রূপকথার মর্মার্থ প্রকাশ করে । এ ছাড়াও ইংরেজি ‘ ফেয়ারি টেল ’ , জার্মান ম্যর্শেন , রুশীয় ‘ স্কাজঈ ’ এবং ফিনীয় ‘ সাগেন ’ হল রূপকথার সমধর্মী।

Read More : Quora

iii. চরিত্র : রূপকথার চরিত্রগুলি সাধারণত কাল্পনিক হয়ে থাকে । রূপকথায় বর্ণিত কয়েকটি চরিত্র হল রাজা – রানি , মন্ত্রী – কোটাল , রাজপুত্র – রাজকন্যা , দাস – দাসী , রাক্ষস – দৈত্য ডাইনি – জাদুকর , পেতনি প্রভৃতি । এ ছাড়াও রূপকথায় থাকে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি , পক্ষীরাজ ঘোড়া , শুকপাখি এবং কিছু কল্পিত পশু।

iv. কাহিনি : রূপকথার কাহিনি বিশ্লেষণে দেখা যায় রূপকথার নায়ক বা নায়িকা সাধারণত কঠিন ও দুরূহ কাজকে অতি সহজে সম্পন্ন করে সাফল্য পায় । অনেক সময় জাদুশক্তি সম্পন্ন কোনো বস্তু বা ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে রূপকথার কেন্দ্রীয় চরিত্র তার প্রতিপক্ষ (রাক্ষস , ডাইনি প্রভৃতি) -দের পরাজিত করে । রূপকথাতে অতিলৌকিক কাহিনি পরিবেশিত হয় । রূপকথায় কাহিনি অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে ব্যাঙ্গমা – ব্যাঙ্গমি , সোনার কাঠি রুপোর কাঠি , জাদু আংটি , জাদু বস্তুর ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া প্রভৃতি।

2.পরিকথা কাকে বলে :

লোককথার আলোচনায় পরিকথা এক স্বতন্ত্র বিষয় । যে পরি কাহিনিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বা মুখ্য ভূমিকা পালন করে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যায় অর্থাৎ যে লোককথায় পরিকে কেন্দ্র করেই কাহিনি আবর্তিত হয় তাকেই বলা হয় পরিকথা ।

চরিত্র : পরিকথার কেন্দ্রীয় চরিত্র হল পরি স্বয়ং । পরিরা ভালোমন্দ দু – ধরনেরই হয়ে থাকে । পরিরা অপরূপ রূপবতী
হয় , তারা সব সময় সাদা পোশাক পরে থাকে । তারা লজ্জাবতী ও বিনয়ী হয় । তারা কম কথা বলে এবং মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে । পরি চরিত্রের পাশাপাশি রূপকথার মতোই বেশ কয়েকটি অন্যান্য চরিত্রের সমাবেশ লক্ষ করা যায়।

কাহিনি : পরিকথায় পরিকে কেন্দ্র করেই কাহিনি বিন্যাস হয়ে থাকে । পরিরা দূর আকাশে থাকে , তারা অতিলৌকিক কাজের সম্পাদনের দ্বারা যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে । থাকে । রূপকথার মতোই পরিকথার কাহিনিরও শুরু এবং সমাপ্তিও প্রায় একই ধরনের । পরিরা অশুভ ক্ষতিকারক দুষ্ট শক্তিদের পরাজিত করেন । ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের রূপকথাগুলিতেই পরিকথার আধিক্য লক্ষ করা যায় । বিদেশি জনপ্রিয় পরিকথা হল ‘ সিন্ডারেলা ‘ এবং ‘ স্লিপিং বিউটি ’ গল্প দুটি।

3.পশুকথা কাকে বলে :

পশুকে নিয়ে কল্পিত গল্পকে পশুকথা বলে । লোককথার বিভিন্ন ভাগগুলির প্রাচীনত্বের বিচারে পৌরাণিক কাহিনি (Myth)-র পরেই এর স্থান।

চরিত্র : পশুকথায় পশুপাখিদের বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলি তুলে ধরা হয় । পশুকথায় পশু , মানুষ , অতিলৌকিক প্রাণী সব মিলেমিশে উপস্থিত হয় । ভবিষ্যৎ বলা শুকপাখি , কথা বলা বানর , উপকারী কুকুর , পণ্ডিত শেয়াল , বোকা কুমির , ধূর্ত শেয়াল , চটপটে খরগোশ , অকৃতজ্ঞ সাপ , উপকারী পাখি এরা সকলেই পশুকথার চরিত্র।

কাহিনি : নানা ধরনের অলৌকিক ও ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়ে পশুকথার কাহিনি বর্ণিত হয় । পশুকথার কাহিনিতে পশুর মানবসুলভ ও পশুসুলভ উভয় ধরনের দোষ – গুণ ধরা পড়ে। পশুকথার কাহিনিগুলি আকারে ছোটো হয়। এর কাহিনিতে মানুষের সামাজিক আচার আচরণ , আশা – আকাঙ্ক্ষা , হীনতা ক্ষুদ্রতা , বীরত্ব বুদ্ধি সবই পশুপাখির প্রতীক হিসেবে প্রকাশিত হয়।

আরও পড়ুন :

কিংবদন্তি কাকে বলে এবং কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব

জাদুঘর কাকে বলে এবং জাদুঘরের উৎপত্তি, অর্থ, উদ্দেশ্য ও প্রকারভেদ

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল

2 thoughts on “লোককথা কাকে বলে ? এবং লোককথার বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও শ্রেনিবিভাগ | What is Folklore And Characteristics, Importance, Classification”

Leave a Comment