অব শিল্পায়ন কি ? অব শিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল | What is De industrialization, Cause And Effect

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

অব শিল্পায়ন কি ? অব শিল্পায়নের কারণ ও ফলাফলঅব শিল্পায়ন  কি ? অব শিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল | What is De industrialization, Cause And Effect :  অব শিল্পায়ন হল একটি দেশের শিল্প ব‍্যবস্থা ধ্বংস করার কৌশল। ভারতে ইউরোপীয়দের আর্বিভাবের পূর্বে ভারত ছিল শিল্পের কেন্দ্রস্থল। ভারতীয় অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প।গ্ৰামীন অর্থনীতির এই ভারসাম্য ব্রিটিশ নীতির কারণে ধ্বংস হয়ে যায়।চলুন দেখে নেওয়া যাক অব শিল্পায়ন কি

অব শিল্পায়ন বলতে কি বোঝ

ভারতবর্ষে ইংরেজদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে বাংলা তথা ভারতের কুটিরশিল্প যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখল করার পর দীর্ঘদিন ধরে ভারতে শিল্পায়ন – বিরোধী বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে । তারা ইংল্যান্ডের শিল্প – কারখানায় উৎপাদিত সামগ্রীর দ্বারা ভারতের বাজারগুলি ছেয়ে দেয় এবং ভারতকে একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করে । এর ফলে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভারতের চিরাচরিত সমৃদ্ধ কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়ে যায় । এই ঘটনা ভারতের ইতিহাসে ‘অব শিল্পায়ন‘ ( De industrialization ) নামে পরিচিত।

অব শিল্পায়নের কারণ

অব শিল্পায়নের কারণ গুলি নিচে আলোচনা করা হল –

1.কাঁচামাল রপ্তানি : ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে কাঁচামাল রপ্তানি শুরু হয়। ভারত ইংল্যান্ডের কলকারখানার খোলা বাজার ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে পরিণত হয় । ভারত থেকে তুলো , নীল , কফি , চা , রেশম প্রভৃতি ইংল্যান্ডে পাঠানো হতে থাকে । এই কাঁচামাল বিলেতে শিল্পের অগ্রগতিতে সহায়তা করে । ফলে কাঁচামালের অভাবে দেশীয় শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হয় ।

2.শিল্পবিপ্লব : অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয় । উন্নত মেশিনের সাহায্যে অনেক কম সময়ে অনেক উন্নত মানের ও সস্তা শিল্পপণ্য , বিশেষ করে সুতিবস্ত্র ইংল্যান্ডের কলকারখানাগুলিতে তৈরি হতে থাকে । ব্রিটিশ শিল্পপতিদের চাপে সরকার ভারতের দরজা ইংল্যান্ডের বণিকদের কাছে খুলে দিতে বাধ্য হয় । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটলে ইংল্যান্ডের অন্য ব্যবসায়ীরা ব্যাপকহারে ভারতে আসতে থাকে । তারা এদেশে জমিজমা কিনে তাতে নীল , কফি , রবার , তামাক প্রভৃতির চাষ শুরু করে এবং কাঁচামাল ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকে । ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে রেলব্যবস্থা চালু হলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ পণ্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটে । এসব পণ্যে ভারতের বাজার ছেয়ে গেলে দেশের বাজারে দেশীয় পণ্য বিক্রি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

3. সুতিবস্ত্রে শুল্ক আরোপ : একদা ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভারতের বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক চাহিদা ছিল । ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদা হ্রাস করে বিলেতি বস্ত্রের চাহিদাবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে ব্রিটেনে রপ্তানি করা সুতিবস্ত্রের ওপর উচ্চহারে শুল্ক দেওয়ার ফলে ব্রিটেনে ভারতীয় সুতিবস্ত্রের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে এর চাহিদা হ্রাস পায়।

4. অসম শুল্কনীতি : কোম্পানি নিজে বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড়ের সুযোগ নিলেও ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন দেশীয় শিল্পপণ্যের ওপর বিশাল শুল্ক আরোপ করে ।

5.অবাধ বাণিজ্যনীতি : ব্রিটিশ সরকার ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটায় । ফলে সকল ইংরেজ বণিকের জন্য ভারতের বাণিজ্যের দরজা খুলে যায় এবং দেশীয় শিল্প – বাণিজ্যে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ।

6.অত‍্যাচার : ভারতীয় শিল্পী ও কারিগরদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের নির্যাতন ও বঞ্চনা দেশীয় শিল্পকে যথেষ্ট ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়। বাংলার তাঁতিরা কীভাবে শোষিত হত তা উইলিয়াম বোল্টস্ – এর রচনা থেকে জানা যায় । কোম্পানির কর্মচারী ও দালালরা তাঁতিদের অগ্রিম দাদন নিতে এবং শুধু ইংরেজ কোম্পানির জন্য সুতিবস্ত্র বুনতে বাধ্য করত।

অব শিল্পায়নের ফলাফল

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ব্রিটিশরা এদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনে সমর্থ হয়। অব শিল্পায়নের ফলাফল গুলি হল-

1.বেকারত্ব : দেশীয় কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে ভারতের বিপুল সংখ্যক হস্তশিল্পী ও কারিগর কাজ হারায়। নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের মতে , শুধু বাংলাতেই ১০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছিল । কর্মচ্যুত হওয়ার ফলে দেশে তীব্র বেকার সমস্যা দেখা দেয়। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে , “ যদি দেশের মানুষ শিল্পকর্ম ছেড়ে চাষ – আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় আয়ে কৃষিজ অংশ বাড়তে থাকে ও শিল্পজ অংশ কমতে থাকে , তবে তাকে অব – শিল্পায়ন বলে । ”

2. কৃষিতে চাপ : অব শিল্পায়নের ফলে জমির অনুপাতে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহে চাপ বাড়ে দেশে কৃষিজীবী ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।

3. গ্রামীণ অর্থনীতির ব‍্যাঘাত : অব শিল্পায়ন ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন সৃষ্টি করে । স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলির দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেলে সেখানে অর্থনৈতিক সমস্যা তীব্রতর হয় । অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে । গ্রামে কৃষি মরসুম ছাড়া অন্য সময় মানুষের কাজ না থাকায় সার্বিকভাবে মানুষের গড় আয় যথেষ্ট কমে যায়।

4. নগরজীবনের অবক্ষয় : অব – শিল্পায়নের ফলে ভারতের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ শহরগুলির অবক্ষয় শুরু হয় । অষ্টাদশ শতকে ঢাকা , মুরশিদাবাদ , সুরাট , মসুলিপট্টম , তাঞ্জোর প্রভৃতি নগর ক্রমে জনবিরল হতে থাকে এবং নগরের অবক্ষয় শুরু হয়।

5.কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ : অব – শিল্পায়নের ফলে ভারতবর্ষ একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয় । এখানকার কাঁচামাল সস্তায় ক্রয় করে ইংরেজ বণিকরা ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকে । ভারতের কাঁচা তুলো , কাঁচা রেশম , নীল , চা প্রভৃতি কাঁচামাল নিয়মিত বিলাতের কারখানাগুলিতে চলে যেতে থাকে । এর ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পায়নে গতি আসে।

6. বিদেশী পণ্য আমদানি : দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের ফলে ভারত একটি রপ্তানিকারক থেকে আমদানিকারক দেশে পরিণত হয় । বিলাতের ম্যাস্টোর , ল্যাঙ্কাশায়ার ও অন্যান্য স্থানের শিল্পজাত পণ্য ভারতে আমদানি শুরু হয় । কেবল সুতিবস্ত্র নয় , রেশম ও পশমজাত দ্রব্য , লোহা , মৃৎশিল্প , কাচ , অস্ত্রশস্ত্র , ঢাল – তলোয়ার , খোদাই ও কারুকার্যের সঙ্গে জড়িত শিল্প প্রভৃতির যথেচ্ছ আমদানির ফলে দেশীয় শিল্পগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

7. দারিদ্র্য বৃদ্ধি : অব – শিল্পায়নের ফলে ভারতের অর্থনীতি ধ্বংস হয় এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায় । দারিদ্র্য , দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ভারতীয় জনজীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।

ড . বিপান চন্দ্রের মতানুসারে , ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যনীতি ব্রিটিশ শিল্প ও শিল্পপতিদের স্বার্থেই পরিচালিত হয়েছিল । এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীকে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্য ব্রিটেনের মুখাপেক্ষী করে রাখা এবং ভারত থেকে ব্রিটিশ পণ্যের জন্য কাঁচামাল আহরণ । মার্কিন গবেষক মরিস ডেভিড মরিস মনে করেন যে , অবশিল্পায়নের ধারণা জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের প্রচারিত এক ‘ অলীক কল্পনা ’ বা মিথ।

আরও পড়ুন : 

শিল্পবিপ্লবের কারণ ও ফলাফল

রুশ বিপ্লবের কারণ

স্মৃতিকথা কাকে বলে এবং গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য

জাদুঘর কাকে বলে ? উৎপত্তি, অর্থ, উদ্দেশ্য, প্রকারভেদ

Leave a Comment