বক্সারের যুদ্ধের কারণ | বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল বা গুরুত্ব

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

বক্সারের যুদ্ধের কারণ | বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল বা গুরুত্ব

বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল বা গুরুত্ব : ভারতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল বক্সারের যুদ্ধ , আজকে আমরা এই যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করবো।

বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল :

1764 খ্রিঃ বাংলার নবাব মিরকাশিম ও অযোধ‍্যার নবাব সুজা-উদদৌলা ও মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত বাহিনী ও ইংরেজ বাহিনীর মধ্যে বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের পিছনে যেমন একাধিক কারণ তেমনি এই যুদ্ধের কতগুলি ফলাফলও রয়েছে।

বক্সারের যুদ্ধের কারণ :

বক্সারের যুদ্ধের কারণ গুলি হল –

1. মিরকাশিমের স্বাধীনচেতা মনোডার :

মিরকাশিম আলি খান ছিলেন এক অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি । মিরজাফর – পরবর্তী তাঁর 3 বছরের নবাবি শাসনে তিনি পূর্ব ভারতে এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন । এই লক্ষ্যপূরণের জন্য তিনি আর্থিক ও সামরিক বিভাগকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন । এ ছাড়াও ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি মুরশিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে (বিহারে) রাজধানী স্থানান্তর করেন । তাঁর এই উদ্যোগ ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করে ঐতিহাসিক ডডওয়েল এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন । “ মিরকাশিম ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে চেয়েছিলেন। ”

2. আর্থিক পদক্ষেপ :

একজন স্বাধীন নবাবের মতোই মিরকাশিম আর্থিক সংস্কারের দ্বারা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। এই পদক্ষেপগুলি হল-

i. তিনি জমিদারদের ওপর কয়েকটি বাড়তি কর চাপান ও ভূমিরাজস্বের হার এক পূর্ণ একের দুই আনা বাড়ান।

ii. ইংরেজদের প্রতি অনুগত রয়েছেন এমন কর্মচারী ও জমিদারদের তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। ইংরেজ মদতপুষ্ট বিহারের নায়েব দেওয়ান নবাবের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ ও হিসাবপত্র দাখিলের আদেশ অগ্রাহ্য করলে তিনি রামনারায়ণকে হত্যা করেন।

Iii. তিনি রাজস্ব আত্মসাৎকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন ও কঠোর শাস্তি দেন।

Iv. আলিবর্দি ও মিরজাফরের পরিবারবর্গের কাছ থেকে তিনি সঞ্চিত অসাধু অর্থ জোর করে আদায় করেন।

3. সামরিক উদ্যোগ :

মিরকাশিম এক প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন । ইউরোপীয় রণকৌশল গ্রহণের পাশাপাশি তিনি উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আফগন , তাতার , পারসিক এবং আরমেনীয়দের সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত করেন। আর্মেনীয় গ্রেগরি (গুরগিন খাঁ) কে তিনি তাঁর প্রধান সেনাপতি ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন । ফরাসি সমরু (ওয়াল্টার রাইন হাউন্ড) -কে ও আর্মেনীয় মার্কারকে তিনি অন্য সমর বিভাগের সেনাপতি নিযুক্ত করেন । এ ছাড়াও আর্মানি কারিগরদের সাহায্য নিয়ে তিনি মুঙ্গেরে কামান ও বন্দুক তৈরির এক অস্ত্রকারখানা নির্মাণ করেন । মিরকাশিমের এই সামরিক উদ্যোগ যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

শুল্ক বিবাদ :

কোম্পানির কর্মচারীরা যথেচ্ছভাবে ব্যক্তিগত বাণিজ্যে দস্তক বা শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিতে শুরু করে। পরিণামে দেশীয় বণিকগোষ্ঠীর বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নবাবও তাঁর প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হন । লবণ , পান ও তামাক ব্যাবসার ক্ষেত্রে ইংরেজ বণিকরা দস্তকের সুযোগ নিয়ে প্রুচর পরিমাণে বাণিজ্য শুল্ক ফাঁকি দেয় । মিরকাশিম নিজে শুল্ক বাবদ বাৎসরিক 25 লক্ষ টাকা ঘাটতির কথা ব্রিটিশ গভর্নরকে জানান।

মিরকাশিম এই সংকটমোচনের জন্য ভ্যান্সিটার্ট – এর কাছে এক আবেদন জানান । কিন্তু তাতেও সংকটের নিরসন না হওয়ায় মিরকাশিম দেশীয় বণিকদের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেন । পলে কোম্পানিকে দেশীয় বণিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যের মুখোমুখি হতে হয় । এতে ইংরেজদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ও তারা মিরকাশিমকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হয় । ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে সংঘটিত হয় বক্সারের যুদ্ধ।

বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল বা গুরুত্ব :

বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব বা ফলাফল গুলি হল

মিরকাশিম , অযোধ্যার নবাব সুজা – উদ্‌দৌলা এবং মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলমের মিলিত জোটের সঙ্গে ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনীর বক্সারের প্রান্তরে যে যুদ্ধ বাধে তা বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত। মিরকাশিমের সেনাপতি মার্কার ও সমরু ইংরেজ সেনাপতি মেজর হেক্টর মুনরোর কাছে পরাজিত (1764 খ্রিঃ, 22 অক্টোবর) হলে , ব্রিটিশ শক্তি সুদৃঢ় হয় । এই প্রসঙ্গে জেম্স স্টিফেন বলেছেন— “ ভারতে ব্রিটিশ শক্তির উৎস হিসেবে বক্সারকে গণ্য করা হয়। ” বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল গুলি নীচে আলোচনা করা হল-

1. ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ হিসেবে :

বক্সারের যুদ্ধ ছিল ভারতের ইতিহাসে এক ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলাফল যদি ইংরেজদের প্রতিকূলে যেত তাহলে ভারতের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হত। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে – “ এই যুদ্ধটি ছিল ভারতের ইতিহাসে সর্বাধিক নিষ্পত্তিমূলক নির্ণায়ক। ”

2. ঔপনিবেশিক শাসনের দৃঢ়তায় :

পলাশির যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছিল। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।

3. বাংলায় আধিপত্য বিস্তার :

পলাশির যুদ্ধে জিতে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির জয়যাত্রার সূচনা ঘটে। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করায় ব্রিটিশ শক্তিকে বাধ্য দেওয়ার মতো আর – কোনো শাসক রইল না। ফলে বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ নিষ্কণ্টক হল।

4. উত্তর ভারতে আধিপত্যে বিস্তার :

বক্সারের যুদ্ধে জেতার পর কোম্পানি বাংলার আধিপত্যকে দৃঢ় করে উত্তর ভারতের দিকে নজর দেয়। অযোধ্যার নবাব সুজা – উদ্‌দৌলা কোম্পানির অনুগত হন এবং নামসর্বস্ব মোগল বাদশা কোম্পানির দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে কোম্পানির আধিপত্যের সূচনা ঘটে । স্যার আলফ্রেড লায়াল এর মতে এই যুদ্ধের ফলে ইংরেজ শক্তি উত্তর ভারতে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়।

5. আর্থিক লুণ্ঠন :

বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় বলা চলে । বাংলায় কোম্পানির অবাধ অর্থনৈতকি লুণ্ঠন শুরু হয়। কোম্পানির উচ্চপদস্থ আমলারা নতুন নবাব নজম উদ্‌দৌলার কাছ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা উপঢৌকন হিসেবে আদায় করে । এর পাশাপাশি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ অযোধ্যার নবাব সুজা – উদ্‌দৌলার কাছ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়।

6. দেওয়ানি লাভ :

বক্সারের যুদ্ধে চরম প্রাপ্তি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা , বিহার ও ওড়িশায় দেওয়ানি লাভ করেছিল। দেওয়ানি লাভের ফলে একদিকে বাংলার রাজনীতিতে কোম্পানির কর্তৃত্ব দৃঢ় হয়েছিল , অপরদিকে কোম্পানির আর্থিক সচ্ছলতা বহুগুণ বেড়েছিল।

মূল‍্যায়ন :

পরিশেষে বলা যায় যে, বক্সারের যুদ্ধের পরেই বণিকের মানদণ্ড শাসকের রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছিল । বক্সারের যুদ্ধে জেতার পর থেকেই ভারতের ইতিহাসে প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয় । এ প্রসঙ্গে র‍্যামসে ম্যুর তাঁর ‘ Making of British India ‘ গ্রন্থে লিখেছেন- “ বক্সার বাংলার ওপর কোম্পানির শাসন – শৃঙ্খলার চূড়ান্তভাবে স্থাপন করেছিল। ”

আরও পড়ুন : 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল 

3 thoughts on “বক্সারের যুদ্ধের কারণ | বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল বা গুরুত্ব”

Leave a Comment