ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য

ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য : ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ু দক্ষিণ এবং দক্ষিণ – পশ্চিম অষ্ট্রেলিয়া, উপকূলীয় ক‍্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিম কেপ এবং ভূমধ‍্যসাগরীয় অববাহিকার চারপাশে ঘটে। পৃথিবীর মোট ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি ভূমধ‍্যসাগরে ঘটে। আজকে আমরা আলোচনা করবো ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য এবং ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ সম্পর্কে।

ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল :

এককথায় উয় নাতিশীতোয় পশ্চিম উপকূলের সামুদ্রিক জলবায়ুকে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু বলা হয় । প্রধানত ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলিতে বেশি করে পরিলক্ষিত হয় বলে এই জলবায়ু অঞ্চলটি ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল নামেই বেশি পরিচিত । অবশ্য পৃথিবীর অন্য যেসব স্থানে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলির মতো জলবায়ু বিরাজ করে , সেগুলিও ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল নামেই অভিহিত হয়। চলুল দেখে নেওয়া যাক ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য গুলি।

ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য :

ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে উন্নতা ও বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে ভূমধ‍্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য গুলি হল –

A. উন্নতার বৈশিষ্ট্য :

1. সারাবছর মাঝারি উষ্ণতা : মধ্য অক্ষাংশীয় অবস্থানের জন্য ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে উন্নতা কখনই খুব বেশি বাড়ে না বা কমে না । সমুদ্র – সংলগ্ন বলেও উন্নতার চরমভাব পরিলক্ষিত হয় না।

2. গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা : গ্রীষ্মকালে এখানকার গড় উন্নতা থাকে 21 ° সেঃ থেকে 28 ° সেঃ- এর মধ্যে। উত্তর গোলার্ধের তুলনায় দক্ষিণ গোলার্ধে উন্নতা কিছুটা কম থাকে। অবশ্য উভয় গোলার্ধেই সমুদ্র থেকে দূরে মহাদেশের অভ্যন্তরভাগে উন্নতা কিছুটা বেশি হয়। গ্রীষ্মকালে আকাশ মেঘমুক্ত থাকে বলে দিনের বেলা সর্বোচ্চ উন্নতা 35 ° সেঃ পর্যন্ত উঠে যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমভাগে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোতে দিনের বেলা সর্বোচ্চ উষ্ণতা কখনো কখনো 45 ° সেন্টিগ্রেডেরও বেশি ওঠে।

3. শীতকালীন উষ্ণতা : ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে শীতকাল f মৃদুভাবাপন্ন । এই সময় গড় উন্নতা থাকে 4 ° সেঃ থেকে 10 ° সেঃ। আকাশে মেঘ থাকে বলে রাতের তাপমাত্রা বেশি কমতে পারে না । তবে সমুদ্র থেকে দূরে এবং উচ্চ ভূমিসমূহে শীতকালে ঠান্ডা একটু বেশিই থাকে । তখন ওইসব স্থানসমূহে মাঝে মাঝে তুষারপাত হয়।

4. উষ্ণতার প্রসর : এখানে বার্ষিক গড় উয়তার প্রসর হয় 11 ° সেঃ থেকে 17 ° সেঃ। অবশ্য সমুদ্র থেকে যত দূরে যাওয়া যায় , এই প্রসর ক্রমশই বাড়তে থাকে । বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর কম হলেও এখানে গ্রীষ্মকালে দৈনিক উষ্ণতার প্রসর বেশি হয় , প্রায় 16 ° সেঃ থেকে 22 ° সেঃ। এর কারণ – গ্রীষ্মকালে আকাশে মেঘ থাকে না , বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকে এবং তখন সূর্যরশ্মি প্রায় লম্বভাবেই পড়ে । এর ফলে যেমন দিনের বেলা উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধি পায় , তেমনি রাতের বেলা উষ্ণতা দ্রুত হ্রাস প্রায় । তাই দিন ও রাতের মধ্যে উষ্ণতার প্রসর সবচেয়ে বেশি হয় । ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর মতো এতটা দৈনিক উষ্ণতার প্রসর শুধুমাত্র উয় মরু জলবায়ুতেই পরিলক্ষিত হয়।

B. বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহের বৈশিষ্ট্য :

1. গ্রীষ্মকালীন অবস্থা : গ্রীষ্মকালে বায়ুর চাপবলয়গুলি যখন কিছুটা উত্তরে সরে যায় তখন ভূমধ্যসাগর ও তার সংলগ্ন এলাকা- সমূহ উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় , ফলে দুই পাশের দুই নিম্নচাপ বলয় ( নিরক্ষীয় নিম্নচাপ ও মেরুপ্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় ) থেকে ঊর্ধ্বগামী বাতাস এই উচ্চচাপ বলয়ে এসে নিম্নগামী হয়।

2. শীতকালীন অবস্থা : শীতকালে সূর্যের দক্ষিণায়নের সময় উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় কিছুটা দক্ষিণে সরে যায় বলে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে আর্দ্র পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয় । ওই সময় মাঝে মাঝে মেরু প্রদেশ থেকে আগত শীতল বায়ুর মাধ্যমে এই অঞ্চলে নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের আবির্ভাব ঘটে।

3. স্থানীয় বায়ুপ্রবাহ : ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অধ্যুষিত দেশগুলিতে স্থানীয় কারণে কতকগুলি বায়ুপ্রবাহ সৃষ্টি হয় । এদের স্থানীয় বায়ুপ্রবাহ বলে । এর মধ্যে কতকগুলি উগ্ন বায়ুপ্রবাহ এবং কতকগুলি শীতল বায়ুপ্রবাহ । উয় বায়ুপ্রবাহগুলি হল – স্পেন , ইটালি ও আফ্রিকার সিরক্কো, টিউনিসিয়ার ঘিলি , আলজিরিয়ার খামসিন , স্পেনের লেভেচ , অস্ট্রেলিয়ার ব্রিকফিল্ডার , দক্ষিণ আফ্রিকার বার্গ , ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্টা আনা প্রভৃতি । আর শীতল বায়ুপ্রবাহগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ফ্রান্সের রোন উপত্যকার মিস্ট্রাল , আড্রিয়াটিক সাগর তীরবর্তী ডালমেশিয়ান উপকূলের বোরা প্রভৃতি।

C. বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য :

1. শীতকালে বৃষ্টিপাত : ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে শীতকালে বৃষ্টি ও গ্রীষ্মকালে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে । শীতকালে বৃষ্টিপাতের কারণ তখন আর্দ্র পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয় । এছাড়া , শীতকালে মধ্য অক্ষাংশীয় বা নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের আবির্ভাবের ফলেও বৃষ্টি হয়।

2. বৃষ্টিপাতের পরিমাণ : বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি নয় , গড়ে বার্ষিক 25 সেমি থেকে 90 সেমি । বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নেপলস্ – এ 87 সেমি , মার্সাই – এ 58 সেমি , জেরুজালেম – এ 53 সেমি , আলজিয়ার্স – এ 77 সেমি , সান ফ্রান্সিস্কো শহরে 57 সেমি , পার্থ শহরে ৪6 সেমি এবং অ্যাডিলেড – এ 55 সেমি । পশ্চিমা বায়ুর গতিপথে পর্বত থাকলে , পর্বতের প্রতিবাত ঢালে 125 সেমি বা তারও বেশি বৃষ্টিপাত হয়।

D. মেঘমুক্ত রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া :

ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাত হয় না , আকাশ মেঘমুক্ত থাকে । শীতকালে বৃষ্টিপাত হলেও তার পরিমাণও খুব বেশি নয় । এরফলে শীতকালেও আকাশ বেশি মেঘাচ্ছন্ন থাকে না । এজন্য ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে বছরের অধিকাংশ সময়ই আকাশ মেঘমুক্ত থাকে বলে প্রচুর পরিমাণে সূর্যরশ্মি পাওয়া যায় । মৃদু উন্নতাযুক্ত এই রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার আকর্ষণে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অগণিত পর্যটক ভূমধ্যসাগরের তীরে ভিড় করেন।

ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ :

  1. এখানে প্রধানত চিরসবুজ উদ্ভিদ জন্মায় যেমন- কর্ক, জলপাই , ইউক্যালিপ্টাস , জারা , কারি , বীচ , উইলো প্রভৃতি গাছ । যেসব জায়গায় শীতকালে তুষারপাত হয় , বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে কিছু সরলবর্গীয় গাছও জন্মায় , যেমন – পাইন , ফার , সিডার প্রভৃতি । এ ছাড়া রোজমেরি , লরেল , ল্যাভেনডার প্রভৃতি গুল্ম বা ঝোপ জাতীয় গাছও দেখা যায় । এই ধরনের ঝোপঝাড় 1. ক্যালিফোর্নিয়াতে চ্যাপারাল 2. ইটালিতে ম্যাকিয়া 3. ফ্রান্সে ম্যাকুইস্ এবং 4. চিলিতে ম্যাটোর‍্যাল নামে পরিচিত । দক্ষিণ আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে ছোটো ছোটো ফুলে ঢাকা ঝোপঝাড় জন্মায় । এগুলিকে স্থানীয় ভাষায় ফিনবস বলে । এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে জনবসতির বিস্তার ও কৃষিকাজের প্রসারের জন্য বহু বনভূমি নষ্ট হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন :

নিরক্ষীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য 

মৌসুমী জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য 

Leave a Comment