মৌসুমী জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য | Features Of Monsoon Climate

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

মৌসুমী জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য | Features Of Monsoon Climate

মৌসুমী জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য – Features Of Monsoon Climate : প্রিয় শিক্ষার্থী আজকের পর্বটিতে আলোচনা করলাম মৌসুমী জলবায়ু কাকে বলে এবং মৌসুমী জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে।

মৌসুমী জলবায়ু কাকে বলে :

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এডমন্ড হ‍্যালি 1656 সালে সর্বপ্রথম মৌসুমী শব্দটি ব‍্যবহার করেন। মৌসুমী শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ মৌসিম বা মালয়ালম শব্দ মনসিন থেকে, যার অর্থ ঋতু। বায়ুর উষ্ণতা ও চাপের পার্থক‍্যে শীত ও গীষ্ম ঋতুভেদে দিক পরিবর্তন কারী ও বিপরীত দিক থেকে নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে প্রভাহিত সাময়িক বায়ুপ্রবাহকে মৌসুমী জলবায়ু বলে।

মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য :

মৌসুমি জলবায়ু আৰ্দ্ৰ ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্গত মহাদেশসমূহের পূর্বভাগে পরিলক্ষিত হলেও কোনো কোনো স্থানে , বিশেষত দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ায় মৌসুমি বায়ুর প্রভাব 30 ° উত্তর অক্ষাংশ, অর্থাৎ উপক্রান্তীয় অঞ্চল পর্যন্ত লক্ষ করা যায় । মৌসুমি বায়ুর আগমন ও নির্গমন অনুসারে এই মৌসুমি জলবায়ুকে চারটি ঋতুপর্যায়ে ভাগ করা যায় – গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত। অবশ্য এখানকার জলবায়ুতে একটি শীত ঋতু থাকলেও প্রধানত আর্দ্র ক্রান্তীয়মণ্ডলের অন্তর্গত বলে মৌসুমি জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য বেশি উয়তা ও আর্দ্রতা।

A. উন্নতার বৈশিষ্ট্য :

1. গ্রীষ্মকাল সর্বাধিক উষ্ণ : গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা খুব বেশি বৃদ্ধি পায় । তবে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় গ্রীষ্মের শেষে , অর্থাৎ বর্ষা শুরু হওয়ার ঠিক আগে। এই সময় গড় তাপমাত্রা 27 ° সেঃ থেকে 32 ° সেঃ হয়। অবশ্য উপকূল থেকে দূরে , দেশের অভ্যন্তরভাগে এই তাপমাত্রা বেড়ে প্রায় 40 ° সেঃ থেকে 50 ° সেঃ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কোনো কোনো স্থানে দিনের বেলা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা 50 ° সেঃ এর বেশি উঠে যায়।

2. চারটির মধ্যে তিনটি উন্ন ঋতু : মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে বিরাজমান চারটি ঋতুর মধ্যে তিনটি ঋতু যথা গ্রীষ্ম , বর্ষা ও শরৎ হল উষ্ণ ঋতু।

3. উষ্ণ লু বায়ুপ্রবাহ : প্রচণ্ড উন্নতার জন্য গ্রীষ্মকালের দুপুরে উত্তর ভারতে গরম ‘ লু ‘ বাতাস প্রবাহিত হয়।

4.বর্ষাকালের উষ্ণতা : বর্ষার শুরুতে অর্থাৎ আর্দ্র মৌসুমি বায়ুর আগমনে আকাশ মেঘে ঢাকা পড়ে , ফলে উষ্ণতা কিছুটা হ্রাস পায়।

5.শরৎকালের উয়তা : শরৎকালে আর্দ্র মৌসুমি বায়ু ফিরে যায় বলে আকাশ অনেকটাই মেঘমুক্ত হয় , ফলে উষ্ণতা কিছুটা বৃদ্ধি পায়।

6. শীতকালের উষ্ণতা : শরতের পর আসে শীত । এই সময় স্থলভাগ থেকে শীতল ও শুষ্ক মৌসুমি বাতাস প্রবাহিত হয় , তার ফলে উষ্ণতা যথেষ্ট হ্রাস পায় । শীতকালে গড় তাপমাত্রা থাকে 10 ° সেঃ থেকে 22 ° সেঃ এর মধ্যে।

7. উষ্ণতার প্রসর : এই জলবায়ুতে বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর ( সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন উষ্ণতার মধ্যে পার্থক্য ) 2 ° সেঃ থেকে প্রায় 12 ° সেঃ পর্যন্ত হয় । আর দৈনিক উয়তার প্রসর প্রায় 16 ° সেঃ পর্যন্ত হয়।

B. বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহের বৈশিষ্ট্য :

1. গ্রীষ্মকালীন বায়ুচাপ : এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে লম্বভাবে পতিত সূর্যরশ্মির জন্য স্থলভাগ দ্রুত উম্ন হয় বলে স্থলভাগের ওপর নিম্নচাপ বিরাজ করে । যেমন- জুলাই মাসে উত্তর – পশ্চিম ভারতে বায়ুর চাপ কমে প্রায় 999 মিলিবার হয়। পূর্ব এশিয়ার কোনো কোনো স্থানে এই বায়ুচাপ 1008 মিলিবার পর্যন্ত হয়।

2. শীতকালীন বায়ুপ্রবাহ : শীতকালে তির্যকভাবে পতিত সূর্যরশ্মির জন্য উন্নতা বেশ কমে যায়। এর ফলে তখন স্থলভাগের ওপর বায়ুর চাপ বেড়ে 1014 থেকে 1026 মিলিবার হয় , অর্থাৎ তখন স্থলভাগের ওপর বায়ুর উচ্চচাপ বিরাজ করে।

3. গ্রীষ্মকালীন বায়ুচাপ : গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের ওপর সৃষ্ট উচ্চচাপ ক্ষেত্র থেকে আর্দ্র বায়ু স্থলভাগের নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে যায়। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় একে দক্ষিণ – পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বলে।

4 .শীতকালীন বায়ুচাপ : শীতকালে স্থলভাগের উচ্চচাপ ক্ষেত্র থেকে শুষ্ক ও শীতল বাতাস জলভাগের নিম্নচাপ ক্ষেত্রের দিকে প্রবাহিত হয় । ভারতীয় উপমহাদেশ – সহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় এই বায়ু উত্তর – পূর্ব মৌসুমি বায়ু নামে পরিচিত।

C. বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য :

1. গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাত : গ্রীষ্মকাল যথেষ্ট আর্দ্র হলেও তখন ব্যাপকভাবে বৃষ্টিপাত হয় না । তবে স্থানীয়ভাবে কোথাও কোথাও অপরাহ্নের দিকে বজ্র – বিদ্যুৎসহ ঝড় – বৃষ্টিপাত হয়, একে পূর্ব ভারতে কালবৈশাখী , দক্ষিণ ভারতে আম্রবৃষ্টি ও উত্তর ভারতে তাকে আঁধি বলে।

2. বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাত : গ্রীষ্মকালের শেষে আর্দ্র মৌসুমি বায়ুর আগমনের মাধ্যমে বর্ষাকালের সূচনা হয় । দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় এই আর্দ্র বায়ু দক্ষিণ – পশ্চিম মৌসুমি বায়ু নামে পরিচিত। মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় 70 থেকে ৪০ শতাংশ এই বর্ষাকালেই ঘটে থাকে‌। এই অবস্থাকে ‘ মৌসুমি বিস্ফোরণ ’ বলে।

অবশ্য বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনিশ্চিত এবং সব জায়গায় সমান হয় না । যেমন- পশ্চিমঘাট পর্বতের প্রতিবাত ( পশ্চিম ) ঢালে বর্ষাকালে প্রায় 300 থেকে 400 সেমি বৃষ্টিপাত হলেও এই পর্বতেরই অনুবাত ( পূর্ব ) ঢালে , অর্থাৎ দাক্ষিণাত্যের অভ্যন্তরভাগে ওই একই সময় মাত্র 50 সেমি বা তারও কম বৃষ্টিপাত হয় । এই সময় মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে প্রায় 900 সেমি , মায়ানমারের পশ্চিম উপকূলে প্রায় 400 সেমি , কক্সবাজার – এ ( বাংলাদেশ ) প্রায় 300 সেমি , কলকাতায় প্রায় 120 সেমি , ঢাকায় প্রায় 140 সেমি বৃষ্টিপাত হয় । এ ছাড়া , EL – Nino- র বছরগুলিতে বৃষ্টিপাত কম হয়।

3. শরৎকালীন বৃষ্টিপাত : শরৎকালে যখন আর্দ্র মৌসুমি বায়ু স্থলভাগ থেকে প্রত্যাবর্তন করে , তখন মাঝে মাঝে সমুদ্রের ওপর সৃষ্ট ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের প্রভাবে উপকূল – সংলগ্ন অঞ্চলসমূহে প্রবল ঝড় এবং কিছু বৃষ্টিপাত হয় । দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ায় এই ঘূর্ণবাতের নাম টাইফুন এবং দুই বাংলায় এটি আশ্বিনের ঝড় নামে অভিহিত।

4. শীতকালীন বৃষ্টিপাত : স্থলভাগের ওপর দিয়ে আসা শীতল ও শুষ্ক মৌসুমি বায়ু ভারতীয় উপমহাদেশে উত্তর – পূর্ব মৌসুমি বায়ুরূপে প্রবাহিত হয় বলে শীতকালে বৃষ্টিপাত হয় না। তবে এই সময় মাঝে মাঝে সুদূর ভূমধ্যসাগর থেকে আসা পশ্চিমি ঝঞ্ঝার কারণে উত্তর – পশ্চিম ভারতের তরঙ্গায়িত সমতল অঞ্চলে সামান্য বৃষ্টিপাত এবং পার্বত্য অঞ্চলে তুষারপাত হয়।

মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ :

1. পর্ণমোচী উদ্ভিদ : মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে প্রধানত পর্ণমোচী বা পাতাঝরা গাছ জন্মায় । শীতকাল শুষ্ক বলে ওই সময় গাছের অধিকাংশ পাতা ঝরে যায় । এইভাবে ঋতু অনুসারে গাছের পাতা ঝরে যায় বলে এখানকার অরণ্যকে বলা হয় ক্রান্তীয় মৌসুমি অরণ্য । শাল , সেগুন , কুল , পলাশ , মহুয়া প্রভৃতি গাছ এই অরণ্যে জন্মায় । এ ছাড়া আম , জাম , নিম , বট , অশ্বত্থ প্রভৃতি গাছ বাংলাদেশ , ভারত প্রভৃতি দেশের প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়।

2. চিরহরিৎ উদ্ভিদ : পাতাঝরা গাছ এই জলবায়ু অঞ্চলের প্রধান উদ্ভিদ হলেও যেসব অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত 200 সেন্টিমিটারের বেশি হয় , সেখানে চিরসবুজ বা চিরহরিৎ উদ্ভিদ দেখা যায় । যেমন- হিমালয়ের পাদদেশ , পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢাল প্রভৃতি এলাকায় চিরসবুজ অরণ্য আছে।

3.কাঁটাঝোপ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ : এ ছাড়া , এখানকার যেসব স্থানে কম বৃষ্টিপাত হয় ( 100 সেন্টিমিটারের কম ) , সেখানে কাঁটাঝোপ , গুল্ম প্রভৃতি জন্মায় ( যেমন- উত্তর – পশ্চিম ভারতে )।

4.ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ : মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের বদ্বীপসমূহে , বিশেষত সমুদ্র – সংলগ্ন এলাকার লবণাক্ত মাটিতে ম্যানগ্রোভ বনভূমিও দেখা যায়।

আরও পড়ুন : 

নিরক্ষীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য 

Leave a Comment