সবুজ বিপ্লব বলতে কি বোঝো ? What is Green Revolution | সবুজ বিপ্লবের পটভূমি, সময়কাল ও ফলাফল

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

সবুজ বিপ্লব বলতে কি বোঝো ? What is Green Revolution | সবুজ বিপ্লবের পটভূমি, সময়কাল ও ফলাফল

সবুজ বিপ্লব বলতে কি বোঝো – What is Green Revolution : ‘ বিপ্লব ’ কথাটির আভিধানিক অর্থ হল ‘ আমূল পরিবর্তন ‘ । কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনই হল সবুজ বিপ্লব । ‘ প্যাকেজ ডিল ’ (Package deal) পদ্ধতিতে দেশের কয়েকটি নির্বাচিত এলাকায় কৃষি উন্নয়নের কার্যক্রম হাতে নেওয়াকেই ‘ সবুজ বিপ্লব ‘ বলা হয়।

সবুজ বিপ্লব কাকে বলে :

1960 – এর দশকে ভারতের গুরুতর খাদ্যসমস্যা সমাধানের জন্য কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক উপকরণের প্রয়োগ শুরু হয় । সেই সময় মূলত জলসেচের প্রসার , উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার , রাসায়নিক সারের পর্যাপ্ত প্রয়োগ এবং কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে উত্তর – পশ্চিম ভারতে , বিশেষত পাঞ্জাব , হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমভাগে কৃষিজাত শস্য উৎপাদনে যে অভাবনীয় অগ্রগতি দেখা যায় তাকেই সবুজ বিপ্লব বলা হয়।

সবুজ বিপ্লবের পটভূমি :

মেক্সিকোর ‘ গম উন্নয়ন কর্মসূচির ’ ( Wheat Development Programme ) কর্ণধার ড . নরম্যান আর্নেস্ট বোৱলগ ( Dr. Norman Earnest Borlaug ) – এর উদ্যোগে 1951 খ্রিস্টাব্দে নতুন গম বীজ উদ্ভাবনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় । এর ফলে মেক্সিকোতে 1961 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গমের হেক্টর প্রতি উৎপাদন 7,000 কেজি দাঁড়ায় যা পূর্বে ব্যবহৃত বীজে হেক্টর প্রতি উৎপাদনের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি । ধানের ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় ম্যানিলাতে ‘ আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সংস্থা ’ ( International Rice Research Institute বা IRRI ) স্থাপনের মাধ্যমে । এখানে উন্নতমানের উচ্চফলনশীল ধানের বীজ উদ্ভাবন করা হয় । ধান গবেষণার কিছু কাজ অবশ্য তাইওয়ানেও হয়।

ভারতে সবুজ বিপ্লবের সময়কাল :

ভারতে ‘ সবুজ বিপ্লব ’ – এর বীজ প্রথম ব্যবহৃত হয় 1964-65 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত খরার বছরে । 1963 খ্রিস্টাব্দে ড . বোরলগের সঙ্গে ভারতের বিজ্ঞানীদের পরিচয় এবং সাক্ষাৎ হয় । এই সময়ে ভারতে বিদেশ থেকে 100 কেজি উচ্চফলনশীল গম বীজ আমদানি করে লুধিয়ানা , পুসা এবং কানপুরের মৃত্তিকায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হয় এবং দেখা যায় স্থানীয় বীজের উৎপাদন অপেক্ষা চারগুণ বেশি উৎপাদন হয় । 1966 খ্রিস্টাব্দে প্রায় 16,000 টন গম বীজ আমদানি করে প্রায় 4 লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় । 1967-68 সালের উৎপাদন 1966-67 – এর উৎপাদন অপেক্ষা প্রায় 25 % বৃদ্ধি পায় । শস্য উৎপাদনের এই অভাবনীয় অগ্রগতির মাধ্যমেই ভারতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় ।

সবুজ বিপ্লবের উপকরণ :

কৃষিক্ষেত্রে যেসব নতুন কৌশল প্রয়োগ করে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় সেই সব উপকরণকে সবুজ বিপ্লবের স্তম্ভ বা উপকরণ বলা হয় । মোট 12 টি উপকরণ নির্দিষ্ট করা হয় , যার মধ্যে মুখ্য বা প্রধান উপকরণ 4 টি ।

1. উচ্চফলনশীল বীজ : সবুজ বিপ্লবে সহায়তাকারী সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল শস্য চাষে উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার । পুরানো বা সাবেকি বীজের তুলনায় এই সব বীজের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি । গম , ধান , জোয়ার , বাজরা এবং ভুট্টা — মূলত এই পাঁচ ধরনের শস্যের মধ্যেই উচ্চফলনশীল বীজ ( HYV ) সীমাবদ্ধ । 1966-67 খ্রিস্টাব্দে উচ্চফলনশীল বীজের আওতায় যেখানে 40 লক্ষ হেক্টর জমি ছিল , সেখানে 2008-09 খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়ায় 4 কোটি 5 লক্ষ হেক্টর ।

2. সেচব‍্যবস্থা : উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহারের জন্য প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয় । তাই জলসেচ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটানো হয় । ভূপৃষ্ঠস্থ জলের পাশাপাশি ভৌমজলেরও ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার শুরু হয় । তবে এই ভৌমজল পর্যাপ্ত ব্যবহারের ফলে ভৌমজলের অবক্ষয় ঘটছে বা জলতল আরও নীচে নেমে যাচ্ছে । পাঞ্জাব ও হরিয়ানার বহু জেলাই এই সমস্যার সম্মুখীন।

3. রাসায়নিক সার : উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহারের জন্য দরকার পর্যাপ্ত রাসায়নিক সারের প্রয়োগ । জমির পুষ্টিসাধক বস্তুগুলির পরিমাণ বাড়লে তবেই উৎপাদন বাড়ে । 1974-75 খ্রিস্টাব্দে ভারতে যেখানে হেক্টর প্রতি রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছিল মাত্র 17 কেজি , 2012-13 খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়ায় 128.34 কেজিতে।

4. কীটনাশক ওষুধ : উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহারের ফলে শস্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে । ভারতে প্রতিবছর প্রায় 10,000 কোটি টাকার শস্য বিভিন্ন প্রকার রোগে এবং কীটপতঙ্গের উপদ্রবে বিনষ্ট হয় । তাই সবুজ বিপ্লবের অধীনে পর্যাপ্তমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়।

5. সক্রিয় এলাকা উন্নয়ন : 1975 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে সক্রিয় এলাকা উন্নয়ন ( Command Area Development বা CAD ) প্রকল্পের অধীনে মৃত্তিকা জরিপ , ভূমির আকৃতি নির্ণয় , জমির মধ্যে খাল খনন , জলের সঠিক নিষ্কাশন ইত্যাদির উন্নয়ন ঘটানো হয় । এছাড়াও সঠিক শস্য বিন্যাস , জলনিকাশি ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ এবং জলসেচের আধুনিকীকরণও এই প্রকল্পের অন্তর্গত ছিল।

6. পাট্টা তহবিল : ভারতে কৃষির উন্নতির জন্য ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন ভূমিকে কৃষকের মধ্যে বিলি করে পাট্টা তহবিল গঠন করা হয় । এর ফলে কৃষকদের মধ্যে শস্য উৎপাদনে বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হয় ।

সবুজ বিপ্লবের ফলাফল গুলি হল :

সবুজ বিপ্লবের ফলাফল গুলিকে মূলত দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে সুফল এবং কুফল।

সবুজ বিপ্লবের সুফল :

সবুজ বিপ্লবের ফলে ভারতের কৃষিক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয় । উল্লেখযোগ্য সুফলগুলি হল-

1. মোট উৎপাদন বৃদ্ধি : সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষিজাত শস্যের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে । তৃতীয় পরিকল্পনাকালে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন যেখানে 8.2 কোটি টন ছিল সেখানে 2011-12 সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় 25.74 কোটি টন । প্রকৃতপক্ষে সবুজ বিপ্লবের ফলেই 1971 খ্রিস্টাব্দে PL – 480 পরিকল্পনা অনুযায়ী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যশস্যের আমদানি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছি।

2. হেক্টর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি : উচ্চফলনশীল বীজ , জলসেচের সুবিধা এবং কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাধ্যমে হেক্টর প্রতি উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় । 1970-71 সালে খাদ্যশস্যের গড় উৎপাদন ক্ষমতা হেক্টর প্রতি ছিল 872 কেজি । এই উৎপাদন 2009-10 সালে বেড়ে দাঁড়ায় 1,798 কেজিতে।

3. খাদ্য সমস্যার সমাধান : স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে ভারতে জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দেয় । কিন্তু সবুজ বিপ্লবের ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সমস্যার সমাধান হয়েছে।

4. কৃষকের সমৃদ্ধি : জমি থেকে উৎপাদন বাড়ায় কৃষকের আয়ও বাড়তে থাকে । তাই তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটে।

5. কৃষকের মানসিকতার পরিবর্তন : কৃষিক্ষেত্রে কৃষক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় তাদের চিরাচরিত ধারণার পরিবর্তন ঘটে । মানসিকতার পরিবর্তনের ফলে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি প্রবর্তন করতে তাদের অসুবিধা হয় না।

6. শিল্পের বিকাশ : সবুজ বিপ্লবের ফলে কার্পাসবয়ন , শর্করা , বনস্পতি প্রভৃতি শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে।

7. গ্রামীণ কর্মসংস্থান : জমিতে সার প্রয়োগ এবং বহু – ফসলি চাষের ফলে গ্রামীণ লোকের কাজের সুযোগ বেড়েছে। গোবিন্দ থুকরাল ( Gobind Thukral ) – এর মতে পাঞ্জাবে প্রায় এক লক্ষ নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় । 15 লক্ষের মতো গরিব মানুষ বিহার , পূর্ব উত্তরপ্রদেশ এবং ওডিশাতে কাজ পায় । তবে এই কর্মসংস্থান বিষয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে।

সবুজ বিপ্লবের কুফল :

সবুজ বিপ্লবের সুফলের পাশাপাশি কিছু ক্ষতিকর প্রভাবও রয়েছে সেগুলি হল –

1. আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি : সবুজ বিপ্লব ভারতের সর্বত্র সমানভাবে সাফল্য লাভ করেনি । পাঞ্জাব , হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশে সবুজ বিপ্লব যতখানি ফলপ্রসূ হয়েছে , অন্যত্র তা হয়নি । এই অসম প্রসারের ফলে আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছ । তবে সাম্প্রতিক কালে এই অসমতা কিছুটা দূরীভূত হয়েছে সবুজ বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ের সুফল হিসেবে।

2. শ্রেণিগত বৈষম্য বৃদ্ধি : অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ধনী চাষি সবুজ বিপ্লবের সুযোগ বেশি মাত্রায় গ্রহণ করে আরও বেশি সচ্ছল হয়েছে । অন্যদিকে , ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি দিনে দিনে বেশি নিঃস্ব হয়েছে।

3. ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থা : কৃষিজ উৎপাদনের নতুন কৌশল পুঁজিবাদী খামার ( Capitalist farms ) গড়ে তুলেছে । একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় , পাঞ্জাবে মাত্র এক – তৃতীয়াংশ প্রান্তিক চাষি এবং 24.5 % ক্ষুদ্র চাষি দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে।

4. অনিশ্চিত কর্মসংস্থান : অনেকের মতে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে।

5. দারিদ্র্যের প্রকোপ : কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে আঞ্চলিক বৈষম্য এবং গ্রামাঞ্চলে মানুষের আয়গত বৈষম্য ঘটায় দারিদ্র্যের প্রকোপ বেড়েছে । অবশ্য অনেকের মতে , উৎপাদন বাড়ায় খাদ্যশস্যের দাম কমেছে।

6. অসম গুরুত্ব প্রদান : খাদ্যশস্য উৎপাদনে কেবলমাত্র গমের ওপরই বেশি মাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হয় । অন্যান্য শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎসাহের অভাব স্পষ্ট । তাই অনেকেই সবুজ বিপ্লবকে ‘ গম বিপ্লব ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

7. কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের অসুবিধা : ব্যাপকমাত্রায় যান্ত্রিকীকরণের ফলে অনেক সময় দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনাজনিত সমস্যার সৃষ্টি হয় । সামাজিক নিরাপত্তাজনিত সুযোগসুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনও সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠেনি।

8. রাসায়নিক সারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার : রাসায়নিক সারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে মৃত্তিকা ও জল দূষিত এবং তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে । অনেকক্ষেত্রে আবার উৎপাদনশীলতা কমেছে।

9. পরিবেশের ওপর কুপ্রভাব : সবুজ বিপ্লবের ফলে পরিবেশের গুণগত মানের অবনমন ঘটছে । মৃত্তিকায় লবণতা বৃদ্ধি , নদী , হ্রদ এবং বিভিন্ন জলভাগে দূষণের মাত্রা বাড়ায় তার প্রভাব উপকূল অঞ্চলের সমুদ্রে স্পষ্ট হয়েছে । তাই সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে। উপরের অসুবিধা গুলির জন‍্য অনেকেই সবুজ বিপ্লবকে ‘ধূসর বিপ্লব‘ হিসেবে আখ‍্যা দিয়েছেন।

আরও পড়ুন : 

সুনামি সৃষ্টির কারণ ও ফলাফল

পর্বত কাকে বলে ? প্রকারভেদ এবং বৈশিষ্ট্য

প্রশ্ন : 

1. সবুজ বিপ্লব প্রথম কোথায় হয়েছিল ?

উ: ভারতে প্রথম সবুজ বিপ্লবের বীজ ব্যবহার করা হয় 1964-65 সালে বিশেষত পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশে ( UP ) তে ।

2. সবুজ বিপ্লবের জনক কে ?

উ: ড: নরম‍্যান আর্নেস্ট বোরলগ।

1 thought on “সবুজ বিপ্লব বলতে কি বোঝো ? What is Green Revolution | সবুজ বিপ্লবের পটভূমি, সময়কাল ও ফলাফল”

Leave a Comment