লিপিড কাকে বলে ? লিপিড বা ফ‍্যাটের উৎস ও শ্রেণীবিভাগ

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

লিপিড কাকে বলে ? লিপিডের উৎস ও শ্রেণীবিভাগ

লিপিড কাকে বলে – what is lipid : প্রিয় পাঠকবন্ধুরা আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে আমরা লিপিড বা ফ‍্যাট কাকে বলে এবং লিপিড বা ফ‍্যাটের উৎস ও শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে নিখুঁত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন‍্য খুবই হেল্পফুল হবে।

লিপিড বা ফ‍্যাট :

ফ্যাট বা লিপিড জীবদেহে কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনের মতো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ। সকল রকম লিপিডকে সাধারণভাবে ফ্যাট বলা হয়। বিভিন্ন রকম কোশীয় পর্দার অনবদ্য গঠনমূলক উপাদান হল লিপিড। শরীরের বিভিন্ন অংশে লিপিড মজুত হিসাবে থাকতে পারে। এই প্রকার পদার্থগুলি সাধারণত জলে অদ্রবণীয়, কিন্তু জৈব দ্রাবক, যেমন- ক্লোরোফর্ম ও মিথানলে দ্রাব্য। এই কারণে জৈব দ্রাবক ব্যবহার করে এদের সহজে পৃথক করা যায়। লিপিড হল ফ্যাটি অ্যাসিডের সঙ্গে যে-কোনো অ্যালকোহলের এস্টার। অনুরূপে ফ্যাট হল কেবল গ্লিসারলের এস্টার।

লিপিড কাকে বলে :

কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সহযোগে গঠিত সাধারণত পোলার দ্রবণে অদ্রাব্য ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যালকোহলের (গ্লিসারলের) এস্টারকে ফ্যাট বা লিপিড বলে।

গ্রিক শব্দ ‘lipos’-এর অর্থ হল ফ্যাট। স্নেহপদার্থ বা ফ্যাট বা লিপিড একপ্রকার জলে অদ্রবণীয় জৈব অণু যা ক্লোরোফর্ম, পেট্রোল, ইথার, বেঞ্জিন প্রভৃতি আয়নিত দ্রবণে সহজদ্রাব্য। বিশ্রামরত অবস্থায় শক্তি চাহিদার তিন ভাগ (75%) শক্তি ফ্যাট জারণের ফলে সরবরাহ হয়।

ফ‍্যাট বা লিপিডের উৎস :

বাদাম, নারকেল, সরষে, তিল, তিসি, সয়াবিন, রেড়ি ইত্যাদিতে উদ্ভিজ্জ ফ্যাট এবং ঘি, মাখন, চর্বি, ডিম ইত্যাদিতে প্রাণীজ ফ্যাট থাকে।

লিপিডের শ্রেণীবিভাগ :

গঠনের ভিত্তিতে লিপিডকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করার যায়, যথা-A. সরল লিপিড B. যৌগিক লিপিড C. লব্ধ লিপিড

A. সরল লিপিড কাকে বলে :

যে সকল স্নেহপদার্থ কেবল ফ্যাটি অ্যাসিড সহযোগে গঠিত হয়, তাদের সরল লিপিড বলে। প্রকৃতপক্ষে, এরা ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যালকোহলের এস্টার। সরল লিপিডকে আবার দুটি শ্রেণিভুক্ত করা যায়, যেমন-ফ্যাট বা ট্রাইগ্লিসারাইড বা অ্যাসাইল গ্লিসারল এবং মোম।

i. প্রাকৃতিক বা প্রকৃত ফ্যাট : এগুলি ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারলের এস্টার। একটি গ্লিসারল অণু তিন অণু ফ্যাটি অ্যাসিডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। ফ্যাটি অ্যাসিডের সংখ্যা অনুসারে এরা মনো বা ডাই বা ট্রাইগ্লিসারাইড এস্টার গঠন করে। প্রাকৃতিক ফ্যাট দুটি অবস্থায় থাকতে পারে, যথা-

a. ফ্যাট বা ট্রাইগ্লিসারাইড বা অ্যাসাইল গ্লিসারল : এই পদার্থগুলি গ্লিসারল ও ফ্যাটি অ্যাসিডের এস্টার। সাধারণত একটি গ্লিসারল, তিনটি ফ্যাটি অ্যাসিডের সাথে যুক্ত হয়ে যখন এস্টার গঠন করে তখন একে বলা হয় ট্রাইগ্লিসারল বা ট্রাইগ্লিসারাইড। এগুলি গৃহ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে। এতে সংপৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রাচুর্য দেখা যায়। যেমন-ঘি, ডালডা ইত্যাদি।

b. তেল : এগুলিও ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারলের এস্টার যা গৃহ তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে। এগুলি অসংপৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ হয়। যেমন- সূর্যমুখীর তেল, বিভিন্ন পরিশুদ্ধ উদ্ভিজ্জ তেল ইত্যাদি।

b. মোম : দীর্ঘ শৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিড ও উচ্চ আণবিক ভরযুক্ত মনো হাইড্রক্সি অ্যালকোহলের (গ্লিসারল ব্যতীত) এস্টারকে মোম বলে। মোম বিভিন্ন রকমের হয়। এর মধ্যে কয়েকটি হল- উদ্ভিজ মোম, মৌ-মোম, ল্যানোলিন, সিবাম, সেরুমেন, সুবেরিন ইত্যাদি।

B. যৌগিক লিপিড :

এই প্রকার লিপিড, ফ্যাটি অ্যাসিড ও বিভিন্ন প্রকার অ্যালকোহলের এস্টার হলেও এতে কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন, নাইট্রোজেন বেস, ফসফেট প্রভৃতি অতিরিক্ত পদার্থের সংযোজন ঘটতে পারে। যৌগিক লিপিড আবার কয়েক প্রকারের হয়, যেমন-

i. ফসফোলিপিড : ফসফোলিপিড হল ফ্যাটি অ্যাসিড, গ্লিসারল (অ্যালকোহল), অপর একটি অ্যালকোহল এবং ফসফেট গ্রুপের ট্রাইগ্লিসারাইড যৌগ। ফসফোলিপিডে দুটি ফ্যাটি অ্যাসিড একটি গ্লিসারল অণুর সঙ্গে যুক্ত থাকে। গ্লিসারলের তৃতীয় হাইড্রক্সিল গ্রুপটি ফসফোরিক অ্যাসিডের সঙ্গে এস্টার গঠন করে। এই ফসফেট গ্রুপটি অপর একটি অ্যালকোহলের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ফসফোলিপিডের প্রকৃতি নির্ধারণ করে।

ফসফোলিপিডের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এগুলি দ্বি-মেরুজ। এদের একটি মেরুজ ও জলাকর্ষী মস্তক এবং দুটি অমেরুজ ও জলবিদ্বেষী লেজ থাকে। লেজটি দুটি দীর্ঘ ফ্যাটি অ্যাসিড অণু নিয়ে গঠিত। ফসফোলিপিডের দ্বৈত-দ্রবণীয়তা ধর্মের জন্য এদের অ্যাম্ফিপ্যাথিক লিপিড বলে। অ্যাম্ফিপ্যাথিক ধর্মের জন্য জলীয় দ্রবণে ফসফোলিপিড অণু তাদের লিপিডে দ্বিস্তরী বিন্যাস প্রদর্শন করে। দুটি স্তরের জলবিদ্বেষী অমেরুজ ফ্যাটি অ্যাসিড শৃঙ্খলদ্বয় একত্রে ভেতরের দিকে অবস্থান করে এবং মেরুজ প্রান্ত দুটি বাইরের দিকে জলের সংস্পর্শে থাকে। ফসফোলিপিডের এই রূপ দ্বিস্তরী গঠন কোশপর্দার গঠনগত উপাদান। এটি কোশপর্দার ভেদ্যতা, সংশ্লেষিত ও পাচিত ফ্যাটের পরিবহণ ও বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্ত তঞ্চনে অংশগ্রহণ করে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফসফোলিপিড হল – লেসিথিন, প্লাজমালোজেন, সেফালিন, স্ফিংগোফসফোলিপিড বা স্ফিংগোমায়োলিন, গ্লিসারল ফসফোলিপিড, ফসফাটাইডিক অ্যাসিড, ইথার গ্লিসারল ফসফোলিপিড।

ii. গ্লাইকোলিপিড : গ্লাইকোলিপিড হল এক বা একাধিক শর্করা সমন্বিত লিপিড তৎসহ নাইট্রোজেন বেস, দীর্ঘ শৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিড বা অ্যালকোহলের জটিল যৌগ। এরা ফসফোরিক অ্যাসিড বহন করে না। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্লাইকোলিপিড হল-

a. সেরিব্রোসাইড : এটি অ্যামাইনো অ্যালকোহল, স্ফিংগোসাইন, ফ্যাটি অ্যাসিড ও শর্করার যৌগ। এরা পুনরায় দু-প্রকারের হয়ে থাকে, যথা- গ্লুকোসেরিব্রোসাইড ও গ্যালাকটোসেরিব্রোসাইড।

b. গ্যাংলিওসাইড : এটি স্ফিংগোসাইন বা ডাইহাইড্রোস্ফিংগোসাইন, ফ্যাটি অ্যাসিড, গ্লুকোজ, গ্যালাকটোজ, N-অ্যাসিটাইল- গ্যাল্যাকটোসামি ও সিয়ালিক অ্যাসিডের যৌগ। সালফোলিপিড এবং সালফাটিড হল গ্লাইকোলিপিডের অন্তর্ভুক্ত যৌগ।

iii. লাইপোপ্রোটিন বা প্রোটিনোলিপিড : এগুলি হল লিপিড ও প্রোটিন যুক্ত ফসফোলিপিড। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লাইপোপ্রোটিন হল – কিউটিন, সুবেরিন।

C. লব্ধ বা ডিরাইভড লিপিড :

এগুলি সাধারণত সরল বা যৌগিক লিপিড থেকে উৎপন্ন আর্দ্র বিশ্লেষিত পদার্থ। এদেরও বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে। লব্ধ লিপিড মূলত দু-প্রকারের, যথা-

i. টারপিন বা আইসোপ্রিনয়েড : 1 অণু 5-C হাইড্রোকার্বনের সঙ্গে অ্যাসিটাইল Co-A-এর ঘনীভবনের সময় 1 অণু আইসোপ্রিন উৎপন্ন হয়। আইসোপ্রিন এককের সাধারণ গঠনটি হল C5H8 । এভাবে দুই বা ততোধিক C5H8 পরপর যুক্ত হয়ে টারপিন গঠন করে যার সাধারণ গঠনকে দ্বারা লেখা হয়। এক্ষেত্রে n = 1, 2, 3, 4… ইত্যাদি হতে পারে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আইসোপ্রিনয়েড হল-

a. স্টেরয়েড : এগুলি ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে উৎপন্ন না হলেও বহুলাংশে ফ্যাটি অ্যাসিডের বৈশিষ্ট্য সমন্বিত। উদাহরণ- স্টেরল , কোলেস্টেরল, আর্গোস্টেরল ।

b. পিত্তলবণ : যকৃতে টরোকোলেট ও গ্লাইকোকোলেট কোলেস্টেরল থেকে সংশ্লেষিত হয়।

c. কর্টিকো-স্টেরয়েড হরমোন : অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে গ্লুকোকর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন, মিনারালো- কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন ও সেবাম স্টেরয়েড হরমোন।

d. যৌন হরমোন : টেস্টোস্টেরন, ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন।

e. তেলে দ্রাব্য ভিটামিন : ভিটামিন A, D, E এবং K আইসোপ্রিনয়েড থেকে উৎপন্ন হয়।

f. এসেনসিয়াল অয়েল ও রঞ্জক : কর্পূর, মেনথল, লিমোনেন, ইউক্যালিপটাস তেল ইত্যাদি এবং ক্যারোটিন, লিউকোপিন প্রভৃতি রঞ্জক টারপিন থেকে উৎপন্ন হয়।

ii. ইকোস্যানয়েড : এগুলি প্যারাক্রাইন হরমোন। এগুলি তিন প্রকারের, যথা- 1. প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন, 2. লিউকোট্রাইয়েন এবং 3. থ্রম্ব্যোজ্যান ।

আরও পড়ুন : 

প্রোটিন কাকে বলে ? প্রোটিনের উৎস,কাজ,গঠন,শ্রেণীবিভাগ ও পুষ্টিগত গুরুত্ব ?

কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা কাকে বলে ? উৎস,শ্রেণীবিভাগ, কাজ ও পুষ্টিগত গুরুত্ব ?

Leave a Comment