সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ কি ? সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের কারণ, ফলাফল, বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ কি ? সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের কারণ, ফলাফল, বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি

সুপ্রিয়, ছাত্রছাত্রীরা আজকের এই পর্বটিতে তোমাদের সাথে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করব। চলো দেখে নেওয়া যাক বিস্তারিত আলোচনাটি।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ কি :

মুঘল আমলে উত্তর ভারতের হিন্দু – মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বহু সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলা ও বিহারে তীর্থভ্রমণে আসত। তাদের অনেকেই এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসও শুরু করে। ব্রিটিশ আমলে কোম্পানি ও তাদের সহযোগী জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা যে বিদ্রোহ করে তা ‘ সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ’ নামে পরিচিত।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের কারণ :

1763 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1802 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার ঢাকা , নাটোর , রংপুর , জলপাইগুড়ি , কোচবিহার , বীরভূম , মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল সেগুলি হল-

1. দান হ্রাস : ব্রিটিশ সরকার বাংলার জমিদার ও কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত রাজস্বের বোঝা চাপালে সন্ন্যাসী ও ফকিররা জমিদারদের কাছ থেকে দানের পরিমাণ কম পেতে থাকে।

2. বাংলায় প্রবেশে বাধা : সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বাংলায় প্রবেশ করতে এবং ধর্মচর্চা করতে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করা হয় । কোম্পানি দরগায় ফকিরদের যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

3. ভূমিরাজস্ব ও কর : যেসব সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস ও কৃষিকাজ করতে শুরু করেন তাদের ওপর সরকার ও জমিদাররা ভূমিরাজস্বের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেন । ভূমিরাজস্ব ছাড়াও তাদের ওপর বিভিন্ন প্রকার কর আরোপ করা হয়।

4. রেশম ব্যাবসী : সন্ন্যাসী ও ফকিরদের অনেকেই রেশম ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের কাছ থেকে প্রায়ই কাঁচা রেশম ও রেশমি পণ্য জোর করে ছিনিয়ে নিত।

5. শোষণ ও অত্যাচার : কোম্পানির কর্মচারী ও জমিদাররা সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর নানাভাবে শোষণ এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য যথেষ্ট উৎপীড়ন চালাত৷

6. তীর্থকর : সন্ন্যাসী ও ফকিরদের তীর্থযাত্রার ওপর সরকার কর বসায় এবং তাদের ধর্মাচরণে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করে।

7. নির্যাতন : সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হয়। 1771 খ্রিস্টাব্দে অন্তত 150 জন ফকিরকে হত্যা করা হয় ।

8. মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ : ইজারাদার , পত্তনিদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীরা সন্ন্যাসী ও ফকিরদের নানাভাবে শোষণ করতে থাকে।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের ফলাফল :

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকরা সর্বপ্রথম যে আন্দোলন গড়ে তোলে তা ‘ সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ‘ নামে পরিচিত । 1763 থেকে 1802 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় 40 বছর ধরে চলা এই বিদ্রোহ বাংলায় সুবিশাল ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

1. বিদ্রোহের সূচনা : 1763 খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জেলায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহ শীঘ্রই নাটোর , রংপুর , ফরিদপুর , ময়মনসিংহ , দিনাজপুর , কোচবিহার , বীরভূম প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

2. আক্রমণ : বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ কোম্পানির কুঠি , রাজস্ব দপ্তর , জমিদারদের বসতবাড়ি , গোলাঘর প্রভৃতি আক্রমণ করে। সাধারণ মানুষের ওপর বিদ্রোহীরা কোনো আক্রমণ চালায়নি।

3. বিদ্রোহীদের সাফল্য : বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। সেনাবাহিনীর প্রতিরোধে বিদ্রোহীরা বীরত্বের পরিচয় দেয়। 1772 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশবাহিনী বিদ্রোহীদের কাছে পরাজিত হয়। ইংরেজ সেনাপতি ক্যাপটেন টমাস নিহত হন। 1773 খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহীদের আক্রমণে ক্যাপটেন এডওয়ার্ডস নিহত হন এবং তাঁর বাহিনী বিধ্বস্ত হয়।

4. বিদ্রোহীদের পরাজয় : ব্রিটিশবাহিনীর চরম দমনপীড়নের ফলে বিদ্রোহীরা ক্রমে পিছু হঠতে থাকে। সাংগঠনিক দুর্বলতা , অনৈক্য প্রভৃতির ফলে বিদ্রোহীরা শেষপর্যন্ত পরাজিত হয় এবং 1802 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিদ্রোহ থেমে যায়।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের চরিত্র :

1763 খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিল বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন। বিভিন্ন পণ্ডিত এই বিদ্রোহের বিভিন্ন চরিত্র বা প্রকৃতি উল্লেখ করে থাকেন৷

1. সন্ত্রাসবাদী চরিত্র : লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী চরিত্র লক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন , এই বিদ্রোহ ছিল ‘ হিন্দুস্থানের যাযাবর ’ ও ‘ পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব ’। তবে হেস্টিংসের মত গ্রহণযোগ্য নয়।

2. কৃষকবিদ্রোহ : কারও কারও মতে , এই বিদ্রোহ ছিল মূলত একটি কৃষকবিদ্রোহ। সন্ন্যাসী ও ফকিররা ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কৃষিকাজই ছিল তাদের প্রধান পেশা। উইলিয়াম হান্টার , এডওয়ার্ড ও গ্যারাট একে ‘ কৃষকবিদ্ৰোহ ’ বলে অভিহিত করেছেন।

3. স্বাধীনতার সংগ্রাম : কেউ কেউ মনে করেন , এই বিদ্রোহ ছিল বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। লেস্টার হ্যাচিনসন মনে করেন , বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিদেশিদের হাত থেকে নিজ দেশ ও ধর্মকে রক্ষা করা ।

4. দুর্বলতা : সন্ন্যাসী ও ফকিরদের আন্তরিকতা থাকলেও তাদের সঙ্গে সমাজের বৃহত্তর অংশের সাধারণ মানুষ বিদ্রোহে শামিল হয়নি। এজন্য বিদ্রোহ কখনোই তীব্র হয়ে উঠতে পারেনি।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য :

ব্রিটিশ কোম্পানি , জমিদার ও বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীর শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন জেলার সন্ন্যাসী ও ফকিররা বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য গুলি হল-

1. দীর্ঘস্থায়িত্ব : সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় 40 বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলে।

2. কৃষকদের বিদ্রোহ : বিদ্রোহী সন্ন্যাসী ও ফকিররা একদিকে ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিল , অন্যদিকে কৃষিকাজ করে তারা জীবিকানির্বাহ করত।

3. হিন্দু – মুসলিম ঐক্য : সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহে হিন্দু – মুসলিম ঐক্য লক্ষ করা যায়। বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী এবং নেতৃত্বদানকারী উভয়ের মধ্যেই হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ ছিল।

4. ব্রিটিশের বিরোধিতা : ব্রিটিশ বিরোধিতাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য। বিদ্রোহীরা ইংরেজ কোম্পানির কুঠি , রাজস্ব দপ্তর প্রভৃতি আক্রমণ করে।

5. জমিদারের বিরোধিতা : বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগী জমিদারদের বিরুদ্ধেও তাদের বিদ্রোহ পরিচালিত করে। বিদ্রোহীরা জমিদারদের বাসভবন , গোলাঘর প্রভৃতিতে আক্রমণ চালায়।

আরও পড়ুন : 

সাঁওতাল বিদ্রোহীদের কারণ, ফলাফল ও বৈশিষ্ট্য

ভিল বিদ্রোহীদের কারণ 

কোল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য 

Leave a Comment