বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে নন্দলাল বসুর অবদান : সুপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা আজকের এই পর্বটিতে আলোচনা করলাম বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে নন্দলাল বসুর অবদান সম্পর্কে। এখানে দুটি উত্তর প্রদান করা হলো তোমাদের পছন্দ মতো যে কোন একটি উত্তর পড়লেই হবে।
বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে নন্দলাল বসুর অবদান :
ভূমিকা : চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুযোগ্য শিষ্য আচার্য নন্দলাল বসু নিজের চারপাশের বহমান জীবনকে ছবির বিষয় করে বাঙালির চিত্রচর্চাকে একটা প্রসারিত ক্ষেত্র দান করলেন। গ্রামীণ প্রকৃতি, সাধারণ এবং দরিদ্র মানুষের জীবন হয়ে উঠল তাঁর ছবির উপজীব্য।
শিক্ষা ও চিত্রচর্চার সূচনা : প্রথমে দ্বারভাঙায় ও পরে কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষা ও চিত্রচর্চার তাঁর বিদ্যার্জন। ছেলেবেলায় কুমোরদের দেখে মূর্তি গড়ে চিত্রকলায় হাতেখড়ি। পরে নিজের আঁকা ছবি সূচনা নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হ্যাভেল সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তাঁরা তাঁকে আর্ট স্কুলে ভরতি করে নে।
কর্মজীবন : রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে 1920 খ্রিস্টাব্দে নন্দলাল শান্তিনিকেতনের কলাভবনে স্থায়ীভাবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই শিল্পশিক্ষার এক বিশেষ পদ্ধতি এই প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করে তোলে। এখানে তিনি মৌলিক রচনা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও পরম্পরা-তিনের মিলনে তাঁর শিক্ষানীতিকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় শিল্পশিক্ষায় তিনিই সর্বপ্রথম আউটডোর স্টাডি বা নেচার স্টাডির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন । নিজের কাজের ক্ষেত্রে তিনি গুরুর স্বচ্ছ জলরঙের ওয়াশ পদ্ধতির পাশাপাশি ঘন জলরঙের টেম্পেরার কাজ শুরু করেন।
চিত্রসম্ভার : শান্তিনিকেতনে যোগ দেওয়ার আগে তিনি এঁকেছিলেন ‘সিদ্ধিদাতা গণেশ’ , ‘সিদ্ধার্থ’ , ‘সতী’ , ‘কৰ্ণ’ , ‘জগাই – মাধাই’ , ‘নটরাজের তাণ্ডব’ , ‘পার্থসারথি’ ইত্যাদি ছবি। কলাভবনে যোগ দেওয়ার পরে দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তর, খোয়াই, মাঠে বিচরণরত মোষ, নারী – পুরুষ, হাটযাত্রী ইত্যাদি ছিল তাঁর ছবির বিষয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি ‘সহজপাঠের অলংকরণ’ , ‘গান্ধিজি’ , ‘রাঙামাটির’ পথ’ ইত্যদি।
অন্যান্য অবদান : ভারতীয় সংবিধানের অলংকরণ, ভারতরত্ন ও পদ্মশ্রী পুরস্কারের নকশা নন্দলাল বসুর অনবদ্য কীর্তি। ভগিনী নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথের গ্রন্থে অলংকরণ ছাড়াও তিনি 1909 খ্রিস্টাব্দে অজন্তা গুহাচিত্রের নকল করার উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। ‘শিল্পচর্চা’ ও ‘রূপাবলী’ তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য শিল্পগ্রন্থ।
মূল্যায়ন : পরিশেষে বলা যায় নন্দলাল বসুর শিল্পকর্মের প্রতিভার জন্য আমরা চোখ বন্ধ করে বলতে পারি চিত্রশিল্পী হিসাবে নন্দলাল বসুর অবদান বাঙালির মনে শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দ্বিতীয় উত্তর :
বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে নন্দলাল বসুর অবদান :
বিহারের মুঙ্গের জেলায় বসবাসকারী খড়ড়্গপুরের এক বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নন্দলাল বসু। তিনি ছেলেবেলায় কুমোরদের দেখাদেখি মূর্তি গড়তেন। তাঁর পিসতুতো ভাই অতুল মিত্র ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র। তাঁর পরামর্শে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে নন্দলাল আর্ট কলেজে অবনীন্দ্রনাথ ও হ্যাভেল সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন ও আর্ট স্কুলে ছাত্র হিসেবে গৃহীত হন।
1906-1915 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর আঁকা বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে- ‘সিদ্ধিদাতা গণেশ’ , ‘শোকার্ত সিদ্ধার্থ’ , ‘সতী’ , ‘শিবসতী’ , ‘জগাই মাধাই’ , ‘কর্ণ’ , ‘গরুড়স্তস্ততলে শ্রীচৈতন্য’ , ‘নটরাজের তাণ্ডব’ , ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা’ , ‘জতুগৃহদাহ’ , ‘অহল্যার শাপমুক্তি’ , ‘পার্থসারথি’ , ‘শিব মুখমণ্ডল’ , ‘শিবের বিষপান’ , ‘যম ও নচিকেতা’ , ‘মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠির’ , ‘উমার ব্যথা’ , ‘উমার তপস্যা’ , ‘প্রত্যাবর্তন’ প্রভৃতি।
পৌরাণিক বিষয়কে ভিত্তি করে আঁকা তাঁর এই ছবিগুলিতে রূপনির্মাণের বিশেষ ভঙ্গি ধরা পড়েছে। 1911 – য় আর্ট স্কুলের পাঠ শেষ করে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে জোড়াসাঁকোয় শিল্পচর্চা নন্দলাল বসুর এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ভগিনী নিবেদিতার বইয়ের চিত্রসজ্জা রচনা করা ছাড়াও তিনি রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথেরও বহু বইয়ের অলংকরণ করেন। লেডি হেরিংহ্যামের সহকারী হিসেবে তিনি অজন্তা গুহাচিত্রের নকল করার কাজ করেন।
নন্দলাল বসুর স্মরণীয় কীর্তির মধ্যে রয়েছে গোয়ালিয়রের বাগ্ গুহার ভিত্তিচিত্রের প্রতিলিপিগ্রহণ, জগদীশচন্দ্রের আহ্বানে ‘বসু বিজ্ঞানমন্দির’ অলংকরণ, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিচিত্র ক্লাবে শিল্প শিক্ষকতা, মহাত্মা গান্ধির আহবানে লখনউ, ফৈজপুর ও হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশন উপলক্ষ্যে ভারতশিল্প প্রদর্শনী সংগঠন, ‘হরিপুরাপট’ অঙ্কন ইত্যাদি। ‘শিল্পচর্চা’ ও ‘রূপাবলী’ তাঁর লেখা শিল্পসংক্রান্ত গ্রন্থ। তিনি রামায়ণ মহাভারতের কাহিনিকে কালীঘাটের রঙিন পটের মতো করে রূপদান করেন। ভারতীয় সংবিধান তাঁরই আঁকা চিত্রে ও নির্দেশে অলংকৃত হয়।