সতীদাহ প্রথা ও রাজা রামমোহন রায় নির্মম ইতিহাস

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

সতীদাহ প্রথা কী :

সতীদাহ প্রথা কি সহজ ভাষায় বলতে গেলে স্বামীর শব দেহ বা মৃতদেহের সঙ্গে বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত দাহ করার নৃশংস পদ্ধতিই হল সতীদাহ প্রথা। কথাটি এমন সহজ ভাবে বললেও প্রাচীন ভারতের হিন্দু সমাজের মধ্যে প্রচলিত এই প্রথাটির বাস্তবিকতা এতটাই নৃশংস ছিল, যা কল্পনা করতে গেলে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে।

সতীদাহ প্রথা

আজকের এই পর্বটিতে আমরা জানবো স্বপ্রণীত আত্মবলিদানের কয়েকটি দৃষ্টান্ত কিভাবে সমাজে রক্ষণশীল, বৃত্তবান এবং প্রভাবশালী মানুষের চরম অমানষিক এবং ধর্মীয় গোরামির দ্বারা কালক্রম এক ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যতিতে পরিণত হয়েছে। আমরা আরো জানবো পৌশাচিক এই সতীদাহ প্রথা সমাজের উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করছিল। কিভাবেই  বা এই অমানষিক প্রথার অবলুপ্তি হয়েছিল এই সমস্ত ইতিহাসকে।

প্রাচীন কাল থেকেই শাস্ত্রের অজুহাত দেখিয়ে বা ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে সদ‍্য বিধবা নারীকে নববধূর মত সাজিয়ে সিঁদুর, কাজল, ফুলের মালা পড়িয়ে চন্দন, আলতায় রাঙিয়ে কিভাবে জ্বলন্ত চিতার উপর তুলে দেয়া হত। সেই নারী তার স্বামীর পা দুটিকে আকড়ে ধরে বা মৃতদেহকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিভ্রান্তির সঙ্গে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না বিধ্বংসী আগুনে তার জীবন্ত দেহখানা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

যাতে শেষ মুহূর্তে নীতিগত এবং দৃশ্যগতভাবে যাতে এই গল্পের কোন ছন্দপতন না ঘটে সেই জন্যই আগে থেকে আফিং বা সিদ্ধি জাতীয় কোন মাদকদ্রব্য খায়য়ে দিয়ে সেই বিধবা নারীকে আচ্ছন্ন করে রাখা হত। অনেক সময় জোর করে হাত পা বেঁধে জোর করে স্বামীর চিতায় তুলে দেয়া হত।

যখন আগুনের শিখা সমস্যা  অসহনীয় গনগনিয়ে জ্বলতে থাকে যদি সিদ্ধির নেশা কেটে গিয়ে সেই বিধবা নারী বিচলিত হয়ে যদি অন্য কোথাও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন কাঠ বা বাঁশ দিয়ে সেই নারীকে আগুনের ভেতর জোর করে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হত। তার করুন কান্নার আর্তনাদ যাতে চারদিকে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য চারপাশে হৌয় হুল্লোর করে  শঙ্খ, ঘন্টা, ঢাক ঢোল বাজিয়ে বদ্ধ উন্মাদের মতো সমাজের এই অমানসিক প্রথা পালন করা হতো, আর এরই নাম ছিল সতীদাহ প্রথা।

সতীদাহের এই ভয়ানক প্রথার কয়েকটি প্রকারভেদ ছিল আর ভয়াবহতার দিক থেকে একটি আরেকটিকে হার মানাতে বাধ্য ছিল। স্বামীর সাথে একসঙ্গে চিতায় পুড়ে মারা গেলে সেটাকে বলা হতো সহমরণ। স্বামীর মৃত্যুর সময় কোন কারনে বিধবা স্ত্রী অসুস্থ থাকলে বা গর্ভবতী থাকলে তাও রক্ষা ছিল না পরবর্তী সময়ে স্বামীর যে কোন জিনিস নিয়ে (যেমন লাঠি, চটি,চিঠি) প্রকৃতি জিনিস নিয়ে চিতায় উঠতে হতো এটাই ছিল অনুমরণ

সতীদাহ প্রথা কে চালু করেন :

এই সমস্ত নরকীয় ঘটনার যদি আমরা উৎপত্তি খুঁজতে যাই তবে দেখতে পাই যে ধর্ম বা শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে তখনকার ব্রাহ্মণ বা উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা এই সতীদাহ প্রথা চালু করেছিল। কিন্তু হিন্দু ধর্মের প্রধান গ্রন্থ বেদে সতীদাহ প্রথার কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি। বরং সেখানে বিধবাদের পুর্নঃবিবাহের কথা উল্লেখ করা রয়েছে।

সতীদাহ শব্দের অর্থ কি :

সংস্কৃত অর্থে সতী শব্দের অর্থ এমন সতী সাদ্ধী রমনীকে বোঝাই যিনি তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত সততার প্রদর্শন করেন এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিও থাকেন তিনি সত্যনিষ্ঠা। কিন্তু আচার হিসেবে সতীদাহ শব্দের অর্থ হল জোর করে একটি জ্বলন্ত জীবনকে হত্যা করারই নমান্তোর।

সতীদাহ প্রথার ইতিহাস :

কোন সময় থেকে সতীদাহ প্রথার উদ্ভব হয় সেই সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক প্রমান মেলেনি। তবে নানান ঐতিহাসিকের নানান মত। কথিত আছে পুরানের দক্ষ রাজার কন্যা ছিল সতী। দেবাদিদেব মহাদেবে শিবের সঙ্গে যিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। চরম ক্ষমতাশালী রাজা দক্ষ এটা মেনে নিতে পারেনি যে শ্মশানে ঘুরে বেড়ানো একজন ছাই ভস্ম মাখা যে কাউকে বিয়ে করে নেবে সতী।

দক্ষরাজ আয়োজিত যৌজ্ঞে সর্বলোক থেকে সবাই আমন্ত্রণপত্র পেলেও নিজের জামাই মহাদেবকেই তিনি আমন্ত্রণ জানাননি। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে প্রতিব্রতা নারী দেবী সতী যৌজ্ঞের চিতায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন যা ছিল একটি আত্মত্যাগ।

ঘটনাচক্রে আমরা যদি মহাভারতের ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাবো পান্ডুর মৃত্যুর পর তার দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দিয়েছিল এবং এটিও ছিল একটি স্বপ্রণদিত আত্মবলিদান।অর্থাৎ প্রতি ক্ষেত্রেই স্ত্রী- স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা দেখিয়ে আত্মবলিদান দিয়েছিলেন। কিন্তু কালক্রমে অতি প্রাচীন এই সতীদাহ প্রথাটি ক্ষমতালোভী এবং সমাজের রক্ষংশীল মানুষের গোঁরা অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা অবক্ষয়িত হয়ে এক ভয়ংকর প্রথার আকার নেই।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ‍্য করা যেত স্বামীর মৃত্যুর পর জোর করে ভয়ানক এবং নৃশংসভাবে ঢাক, ঢোল বাজিয়ে স্বামীর চিতার জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো। স্বপন বসুর ‘বাংলা নবচেতনার ইতিহাস‘ বইতে উল্লেখ রয়েছে এখনকার দিনের ধনী কোন কোন পরিবার থেকে ব্রাহ্মণদের দুইশত টাকা সাম্মানিক দেওয়া হত আর টাকার লোভে ব্রাহ্মণরা বিভিন্ন কৌশলে বিধবা নারীদের সতী হতে বাধ্য করত।

খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ শতকে আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করলেন সে সময়কার লেখনীতে বলপূর্বক সতীদাহের উল্লেখ রয়েছে। এবং উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে অর্থাৎ সতীদাহ প্রথা রদ হওয়ার আগে পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষের চেয়ে কলকাতা তথা বাংলায় সতীদাহের ঘটনা বেশি লক্ষ্য করা যায়।

সতীদাহ প্রথা ও রাজা রামমোহন রায় :

সতীদাহ প্রথা ও রাজা রামমোহন রায়

সালটা 1817 ভয়ানক এই প্রথার বিরুদ্ধে কলম ধরলেন রাজা রামমোহন রায় বিভিন্ন শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থাদি উল্লেখ করে তিনি লিখলেন সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ নামক একটি প্রবন্ধ। তিনি বোঝালেন হিন্দু ধর্মের কোন গ্রন্থে সতীদাহের উল্লেখ নেই এটি আসলে একটি নারী হত্যারই নামান্তর। আর রামমোহনের লেখা এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হতেই সমাজের ধর্মীয় রক্ষণশীল ব্যক্তিদের চরম প্রতিবাদ সংগঠিত হতে দেখা যায় রামমোহনের বিরুদ্ধে।

সতীদাহ প্রথা কে কবে রদ করেন :

1819 সালে তৎকালিক হিন্দু সমাজের একাংশ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে সতীদাহ প্রথা রদ করার জন্য আবেদন পেশ করেছিলেন। এবং পুরোপুরিভাবে 1829 সালের 4 ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা রদ আইন পাশ হয় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর দ্বারা।তখনকার হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিরা এই আইনকে হিন্দু ধর্মের আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করলেন। এবং বেন্টিং এর এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে লন্ডনের পি ভি কাউন্সেলিংয়ে  মামলা করে দিলেন।

সতীদাহ প্রথা কে নিষিদ্ধ করেন :

রক্ষণশীল এই হিন্দুদের গুরুম আচরণের বিরুদ্ধে রামমোহন প্রাণপণ চেষ্টা করেগেলেন এবং দিল্লির বাদশাহের       সহায়তায় 1830 সালে বিলেত পৌঁছে গেলেন। দিল্লির বাদশা রামমোহনকে রাজা উপাধি দান করেন। রাজা রামমোহন রায় সমস্ত শাস্ত্র উল্লেখ করে পি ভি কাউন্সিলিংয়ে প্রমাণ করলে দিলেন ভারতীয় শাস্ত্রে সতীদাহ প্রথা বলে কোন প্রথার উল্লেখ নেই।

অবশেষে 1832 সালের 12 ই জুলাই এই সুনামির সমাপ্তি ঘটে। আইনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল অমানষিক অন্ধকারময় এই সতীদাহ প্রথা। সতীদাহ প্রথা তো রোধ হলো কিন্তু একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আজও আমরা পুরোপুরি ভাবে মুক্ত হতে পারেনি অনেক ভয়ংকর সামাজিক ব্যভিচার থেকে, নারী নির্যাতন, উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ভয়ংকর ঘটনা গুলো সমাজের চরম অন্ধকারময় অধ্যায় গুলোকেই আজও খবরের কাগজের পাতায় স্থান করে দিয়ে চলেছে।

আরও পড়ুন : 100+ Gk In Bengali

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন : 

1. সহমরণ প্রথা কি ?

উ: স্বামীর সাথে একসঙ্গে চিতায় পুড়ে মারা গেলে সেটাকে বলা হতো সহমরণ প্রথা।

2.অনুমরণ প্রথা কি ?

উ:স্বামীর মৃত্যুর সময় কোন কারনে বিধবা স্ত্রী অসুস্থ থাকলে বা গর্ভবতী থাকলে তাও রক্ষা ছিল না পরবর্তী সময়ে স্বামীর যে কোন জিনিস নিয়ে (যেমন লাঠি, চটি,চিঠি) প্রকৃতি জিনিস নিয়ে চিতায় উঠতে হতো এটাই ছিল অনুমরণ।

3. সতীদাহ প্রথা কে কবে নিষিদ্ধ করেন ?

উ: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক 1829 সালে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন।

4. কোন সংবাদপত্র সতীদাহ প্রথার পক্ষে প্রচার করেছিল ?

উ: খ্রিস্টান মিশনারি এবং ইঙ্গ ভারতীয় সংবাদপত্র।

5. কোন গভর্নর জেনারেল সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন ?

উ: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং

6. গৌরিদান প্রথা কি ?

উ: প্রাচীনকালের মেয়েদের বয়স ১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে হলেই তাকে বিয়ে দিতে দিয়ে দিতে হতো না হলে সেই পরিবারকে এক ঘরে করে রাখা হতো এটাই ছিল গৌরী প্রথা।

7. রাজা রামমোহন রায়কে রাজা উপাধি কে দিয়েছিল ?

উ: দিল্লির বাদশা দ্বিতীয় আকবর

8. সতীদাহ প্রথা নিবারনের রামমোহনের ভূমিকা

উ:

1 thought on “সতীদাহ প্রথা ও রাজা রামমোহন রায় নির্মম ইতিহাস”

Leave a Comment