ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রসারে ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের পরিচয় দাও

টেলিগ্ৰামে জয়েন করুন

ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রসারে ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের পরিচয় দাও

ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রসারে ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ : আজকে তোমাদের শেয়ার করলাম ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ সম্পর্কে। ইতিহাসের এই প্রশ্নটি মাধ‍্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন‍্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতবর্ষে দেশীয় শক্তিগুলির মধ্যে মারাঠাদের দিক থেকে ইংরেজ শক্তির প্রতিবন্ধকতার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল । যদিও 1761 খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পানিপতের যুদ্ধে মারাঠা শক্তি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় । তবে পেশওয়া মাধব রাওয়ের নেতৃত্বে পুনরায় মারাঠারা মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে । তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে মারাঠা প্রাধান্য কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন । কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে মারাঠা শক্তি পুনরায় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে । ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও ডাফ মনে করেন যে , মাধব রাওয়ের অকালমৃত্যু মারাঠাদের জন্য তৃতীয় পানিপতের যুদ্ধের থেকেও বড়ো বিপর্যয় ছিল । মাধব রাও – এর মৃত্যুর পর মারাঠাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটলে ইংরেজদের পক্ষে মারাঠাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের পথ সুগম হয়।

প্রথম ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ ( 1775-1782 ) :

প্রথম ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট :

প্রথম মাধব রাও এর অকালমৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা নারায়ণ রাও পেশওয়া হন । মাধব রাও তাঁর পিতৃব্য রঘুনাথ রাও বা রাঘোবা – র চক্রান্তে নিহত হন । রঘুনাথ রাও নিজেকে পেশওয়া বলে ঘোষণা করেন । কিন্তু নানা ফড়নবিশ , সখারামবাবু প্রমুখ মারাঠা নেতা রঘুনাথ রাওকে সমর্থন করেন না , বরং তাঁকে পুনা থেকে বিতাড়িত করেন । এই অবস্থায় রঘুনাথ রাও ইংরেজদের শরণাপন্ন হন । ইংরেজ ও রঘুনাথ রাও – এর মধ্যে 1775 খ্রিস্টাব্দে সুরাটের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় । এর ফলে ইংরেজদের সাহায্যের আশ্বাস লাভ করেন রঘুনাথ রাও।

প্রথম ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের সূত্রপাত :

ইংরেজ ও রঘুনাথ রাও এর মিলিত বাহিনী 1775 সালে আরাসের যুদ্ধে পেশওয়ার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে । মারাঠা নেতা নানা ফড়নবিশ হায়দার আলি ও নিজামের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান ইংরেজদের বিরুদ্ধে।

সলবাই এর সন্ধি : দীর্ঘ 7 বছর যুদ্ধ চলার পর অবশেষে 1782 খ্রিস্টাব্দে সলবাই – এর সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় । এই সন্ধির ফলে প্রথম ইঙ্গ – মারাঠা যুদ্ধের অবসান ঘটে । এই সন্ধির দ্বারা স্থির হয়-

1. দ্বিতীয় মাধব রাওকে পেশওয়া বলে মেনে নেবে ইংরেজরা।

2.রঘুনাথ রাওকে বার্ষিক ৩ লক্ষ টাকা বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করা হবে।

3. সলসেট , থানে ও মুম্বই – সংলগ্ন কিছু অঞ্চল লাভ করবে । ইংরেজরা ।

4. ইংরেজরা মারাঠা সাম্রাজ্যের অধিকৃত অঞ্চল ফেরত দেবে । এই সন্ধির গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঐতিহাসিক সরদেশাই মন্তব্য করেছেন , “ এই সন্ধি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ রচনা করে ” ( “ This Treaty ( of Salbai ) forms an important landmark in the political history of India ” )।

দ্বিতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ ( 1803-1805 ) :

মারাঠা সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে । মারাঠা সাম্রাজ্যের দুর্বলতা প্রকাশ পায় , পেশওয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারেন না । হোলকার দ্বিতীয় বাজিরাওকে পুনা থেকে বিতাড়িত করলে দ্বিতীয় বাজিরাও ইংরেজদের শরণাপন্ন হন।

বেসিনের সন্ধি : দ্বিতীয় বাজিরাও ইংরেজদের শরণাপন্ন হয়ে 1802 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের সঙ্গে বেসিনের সন্ধি স্বাক্ষর করেন । এই সন্ধি অনুযায়ী-

1. পেশওয়া অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিতে আবদ্ধ হন।

2. পেশওয়াকে রক্ষা করার জন্য পুণেতে একদল ইংরেজ সৈন্য রাখা হয়।

3. এই ইংরেজ সৈন্যদলের ব্যয়নির্বাহের জন্য পেশওয়া তাঁর রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দেন ইংরেজদের।

4. পেশওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট রাখা হয় পুণেতে।

5. পেশওয়া তাঁর সেনাবাহিনীতে কোনো ইউরোপীয়কে নিয়োগ করতে পারবেন না বলে স্থির হয়।

6. স্থির হয় ইংরেজদের অনুমতি না নিয়ে পেশওয়া অন্য কোনো তৃতীয় শক্তির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে পারবেন না ।

7. মারাঠা সামন্তদের বিরোধের ক্ষেত্রে কোম্পানির মধ্যস্থতা পেশওয়া মেনে নেবেন বলে স্থির হয়।

এই সন্ধি সম্পর্কে ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন , “ বেসিনের সন্ধি ছিল ওয়েলেসলির ওস্তাদের মার ” ( “ The Treaty of Bassein was Wellesley’s master stroke ” )

দ্বিতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের সূত্রপাত :

দ্বিতীয় বাজিরাও বেসিনের সন্ধির সকল শর্ত মেনে নিতে পারেননি । সিন্ধিয়া এবং ভোঁসলেও এই সন্ধির বিরোধিতা করেন । এর ফলস্বরূপ 1803 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তিনজনের মিলিত এই মারাঠা শক্তি ।

যুম্বের অগ্রগতি ও পরিণতি : দিল্লি , ওয়াড়গাঁও এবং লাসওয়ারির যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয় সিন্ধিয়া । সিন্ধিয়া পরাজিত হয়ে সুরজ অর্জুনগাঁও – এর সন্ধি স্বাক্ষর করেন । অপরদিকে ভোঁসলে দেওগাঁও – এর সন্ধি স্বাক্ষর করে অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতিতে আবদ্ধ হন । যুদ্ধের পরিণতি হিসেবে দেখা যায় ইংরেজরা মারাঠা সাম্রাজ্যের পতন প্রায় নিশ্চিত করে ফেলে।

তৃতীয় ইঙ্গ – মারাঠা যুদ্ধ ( 1817-1819 ) :

দ্বিতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের ফলে পেশওয়া এবং অন্যান্য মারাঠা নেতারা আবদ্ধ হন অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিতে । কিন্তু অচিরেই এই অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি থেকে তাঁরা সকলেই মুক্ত হওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন । পেশওয়ার মন্ত্রী ত্রিম্ব্যকাজিকে মিথ্যা অভিযোগে ইংরেজ রেসিডেন্ট বন্দি
করলে মারাঠারা ক্রুব্ধ হয়ে ওঠে । লর্ড হেস্টিংস পেশওয়াকে 1817 খ্রিস্টাব্দে পুনা চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে । এই পুনা চুক্তি ছিল অপমানজনক , তাই মারাঠা নেতৃবর্গ এই চুক্তি মেনে নিতে পারেননি । ফলে সিন্ধিয়া , ভোঁসলে ও হোলকার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে শুরু হয় তৃতীয় ইঙ্গ – মারাঠা যুদ্ধ।

যুদ্ধের অগ্রগতি ও পরিণতি : ইংরেজদের কাছে সীতাবলিত – এর যুদ্ধে পরাজিত হন ভোঁসলে 1817 খ্রিস্টাব্দে । হোলকার ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন মাহিদপুরের যুদ্ধে । 1818 খ্রিস্টাব্দে পেশওয়া ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন অস্টির যুদ্ধে । পেশওয়া পরাজিত হয়ে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে যুদ্ধের অবসান ঘটে।

তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের ফলাফল :

1. পেশওয়া ইংরেজ কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন।

2. পেশওয়া ’ পদের বিলুপ্তি ঘটে।

3. কোম্পানির অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিতে আবদ্ধ হন হোলকার ও সিন্ধিয়া।

4. ইংরেজদের সাম্রাজ্যভুক্ত হয় ভোঁসলের রাজ্য । মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনের ফলে ভারতে ইংরেজদের শক্তিশালী এক প্রতিদ্বন্দ্বীর পতন ঘটে । এই প্রসঙ্গে পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন , “ In that year ( i.e. 1818 ) the British dominion in India became the British dominion of India ” ।

আরও পড়ুন : 

পিটের ভারত শাসন আইনের ধারা, শর্ত, গুরুত্ব 

Leave a Comment